প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব
নবম পর্ব
সিজন-১ (কন্টিন্যুড)
স্থান – কলকাতা কাল – ১৯৪৯ সাল ডিসেম্বর মাস
১
-
ঝুনুর বিয়েটা শেষপর্যন্ত শ্রাবণে
নয় অঘ্রাণে হয়েছে, সুসম্পন্নই হয়েছে বলা যায়। উপেন তার ভাইয়ের সাথে কালীঘাটের
মেসটি ছেড়ে জগুবাজারের কাছে একটা তিনতলা বাড়ীর দোতলা কোণের দিকের তিনটে ঘর ভাড়া
নিয়েছে। ঝুনু প্রথম একমাস চম্পাহাটিতে শাশুড়ীর কাছে থেকে এলো। শাশুড়ীই এবার
বৌ’কে জগুবাজারের
বাড়িতে রেখে ছেলের সংসার পেতে দিয়ে যেতে
এসেছেন। দিন দশ পনেরো থেকে সবদিক দেখেশুনে
গুছিয়ে তারপর যাওয়া। দুই ছেলেই অবশ্য মা’কে এখানেই থেকে যেতে বলছে। কিন্তু বেশীদিন থাকা তাঁর পক্ষে
সম্ভব হবে না। কর্তা গেছেন ওপারে, দেশের বাড়ির পাট একেবারে চুকিয়ে আসবেন এবার,
এদিকেও তো অল্পস্বল্প কিছু জমি কেনা হয়েছে, তারই দেখাশোনা, বাড়িতে জা’য়েরা আছেন যদিও তবু আরো তিন
মেয়ে আর ছোট ছেলে রয়েছে, জা’য়েদের ছেলেমেয়েরাও আছে। কর্তারা কেউ নেই, এই এতবড়
পরিবারের সব দেখাশোনা তাই তাঁরা চার জা’য়ে মিলেই করছেন আপাতত। উপেনের বিয়ে গেল, এখনও আত্মীয় পরিজন আসছেন
মাঝেমাঝেই নতুন বৌয়ের সাথে আলাপ করতে, তাঁদেরও আদর আপ্যায়ন দেখতে হয়। আত্মীয় এবং প্রতিবেশী কেউ কেউ তাঁ বারণ করেছিলেন
বৌকে ছেলের কাছে এক্ষুনি পাঠাতে। কলকাতা
থেকে আর কতক্ষণই বা লাগে তাঁদের বাড়ি, ওটুকু রাস্তা উপেন প্রত্যেক শনিবার করে
যাবেখনে। কিন্তু এইসব মেস ফেস তাঁরও তেমন পছন্দ নয়, কর্তাও বলেন বাইরের রাঁধুনি
ঠাকুরদের রান্নার চেয়ে বাড়ির নুনভাতও ভাল। তা বৌটি তাঁর হয়েছে শান্ত, বাধ্য। তাই তিনিও ভরসা করে
ছেলেকে আলাদা বাড়ি নিতে বলেছিলেন। বাড়িটা বৌয়ের বাপের বাড়ির কাছে হওয়ায় হঠাৎ দরকারে
সেখান থেকে সাহায্য পাবে ওরা, আর আসা
যাওয়া তো রইলই, সুবিধে অসুবিধে তিনিও দেখেই নেবেন। কর্তারা সব বরাবরের মত এপারে চলে এলে এসে আরো কিছুদিন থেকে যাবেনখন।
ঝুনু এই বাড়িতে এসে খুশীই হয়। জন্ম ইস্তক ঐ
ভবানীপুরের বাড়ি আর টালিগঞ্জে দিদিমার কাছে মামাবাড়িই থেকেছে। আর কোথাও তেমন যায়ও
নি, গ্রামদেশ দেখেও নি। তাই চম্পাহাটি গিয়ে ওর খানিক অসুবিধেই হচ্ছিল। একে তো
অজানা অচেনা লোকজন, তায়
অচেনা পরিবেশ, সন্ধ্যে হতে না হতেই
কি জোর ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়। ওর বাপের
বাড়ি ইলেকট্রিক আলো তাই ওখানে গিয়ে যখন দেখল সন্ধ্যে হতে হারিকেন আর লম্ফই
ভরসা তখন বেশ খারাপ লেগেছিল। তাও বৌভাতের দিন আর পরের যে কদিন আত্মীয় স্বজন ছিলেন
বাড়িতে, তিন চারটে হ্যাচাকলন্ঠন ছিল। ওতে বেশ
আলো হয়, সঙ্গে পোকাও আসে কতরকম পিলপিল করে। ঝুনুর আবার পোকায় খুব ঘেন্না। তখন তো শ্বশুর, জেঠশ্বশুর, খুড়শ্বসুর সবাই বাড়িতে তাই আশেপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোক
আসত দেখা করতে, দিনের কাজকর্ম শেষে বাড়ি ফিরে মুখহাত ধুয়ে এসে ওদের বৈঠকখানায় বসত।
তারপর সুখ দুঃখের গপ্পোগাছা, পূর্ববঙ্গের
অবস্থা, ডালচালের দাম বেড়ে আকাশ ছোঁয়া, শেয়ালদা স্টেশানে কলেরা লাগা - এ সব
নিয়েই আলোচনা চলত ঘন্টার পর ঘন্টা। এদিকে
রাত একটু গভীর হলেই বাঁশবন থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। প্রথম দিন তো ঝুনুর মুখ সাদা হয়ে দাঁতেদাঁত
লেগে যাচ্ছিল ভয়ে। সেই নিয়ে ননদ দেওরদের
কি হাসাহাসি। এদিকে বিয়ের আগে খোকন, চুনিমামা
আর ছোটমামা মিলে ভয় দেখিয়েছে
শ্বশুরবাড়িতে বাথরুম নেই, ওখানে নাকি মাঠে বাথরুম যেতে হয় আর পুকুরে স্নান করতে হয়। ঝুনু ভয়ে ঘেন্নায়
কী করবে ভেবে পায় নি। বাবা মা’কে কিছু বলার সাহস নেই,
বারেবারে টুনু আর খোকনকেই জিগ্যেস করে গেছে বেচারি এসব সত্যি কিনা। খোকনটা
বড় পাজি, খালি মিটমিট করে হাসে আর বলে ‘দেখবি মেজদি মাঠে সব্বাই গিয়ে বসেছে তুইও বসে
পড়বি।’ ঘেন্নায় ঝুনু কতদিন ভাল করে ভাত খেতে পারে নি। টুনু পরে
বুদ্ধি দিয়েছিল ‘মেজদি তুই জামাইবাবুকে বলিস একটা বাথরুম সবার জন্য বানিয়ে
দিতে, তাহলে সকলেরই সুবিধে হবে। ঝুনু তাতেও খুব ভরসা পায় নি। কে জানে বাবা বর হয়ত
খুব রাগী! প্রথমদিন এসে বৌ বরণের পর থেকেই কাঁটা হয়ে ছিল এই বুঝি মাঠে নিয়ে যায়
কেউ। কিন্তু নাঃ খুড়শাশুড়ি ননদকে ডেকে বললেন নতুন বৌ’কে দোতলার বাথরুমে নিয়ে যেতে, হাতমুখ ধুয়ে বেনারসী ছেড়ে নরম তাঁতের কাপড় পরে বসুক
একটু, পাড়া থেকে সব মেয়েরা এসেছে নতুন বৌয়ের সাথে আলাপ করতে। ‘দোতলার বাথরুম’ শুনেই ঝুনু অনেকটা স্বস্তি
পেয়েছিল, গিয়ে দেখল বাথরুমটা ওদের
ভবানীপুরের বাড়ির চেয়ে আকারেও বড় আর বেশ
তেল সাবান নতুন গামছা দিয়ে সাজানো। লম্ফ রাখার উঁচু তাকও আছে, যাতে জলের
ছিটে বা জানলা দিয়ে আসা হাওয়ায় নিভে না যায়।
২
-
অফিস ফেরত প্রমদা এলেন মেয়ের নতুন
সংসার দেখেশুনে যেতে, কিছু অসুবিধে কোন প্রয়োজন আছে কিনা। এমনিতে এই কাছেই জামাইয়ের আলাদা বাড়ি নেবার
খবরে বাড়ির আর সবাই খুশী হলেও তাঁর নিজের
খুব পছন্দ হয় নি। এক তো বিবাহিত মেয়েদের ঘন ঘন বাপের বাড়ি আসা ভাল বলে মনে করেন
না, ওতে শ্বশুরবাড়ির প্রতি টান জন্মানোর সময় পায় না। এক গাছের ছাল তুলে অন্য গাছে
বসাতে গেলে তো একটু বেশী সময় ছালটাকে অন্য গাছটার সাথে আটকে রাখতে হবে রে বাপু। ঐ
বছরে একবার দুবার ৫-১০ দিনের জন্য আসাই ঠিক আছে। অবশ্য সে দেখতে গেলে সরলার বাপের
বাড়িও বেশ কাছেই। তবে সরলা অন্য ধাতুর মানুষ। প্রমদার মন বুঝে তিনি বাপের বাড়ি
প্রায় যানই না। গেলেও দিনে দিনেই চলে আসেন সাধারণতঃ। কিন্তু এ এত কাছে যে টুক করে
একঘন্টার জন্যও ঘুরে যেতে পারবে ঝুনু। তাছাড়া খোকন ওর বড় ন্যাওটা ছিল, সে হয়ত
ইস্কুল ফেরত রোজ রোজই চলে এলো জামাইবাড়ি – সে ভারী খারাপ ব্যপার হবে। থাক খোকনকে নাহয়
কাছে ডেকে বুঝিয়ে বলবেন। অন্য যে কারণটি, বা বলা ভাল আশঙ্কাটি তাঁর মনে দানা বেঁধেছে সেটি
একটু জটিল। কারো সাথে এ নিয়ে আলোচনা করাও সম্ভব নয়। নিজে তিনি বহুকাল যাবৎ পরিবার
নিয়ে পৈত্রিক বাড়ি থেকে অনেক দূরে বাস করেছেন চাকরিসুত্রে, ফলে তাঁর চরম দুরবস্থার সময়ও পৈত্রিক সম্পত্তির
উপর ন্যায্য অধিকারটুকু তাঁকে দেওয়া হয় নি।
আজ উপেন-ঝুনু বাড়ি থেকে সরে আলাদা থাকলে যদি ওরাও ন্যায্য অংশ থেকে একইভাবে
বঞ্চিত হয়! ঝুনু নাহয় থাকতই শ্বশুরবাড়ি,
শাশুড়ি জেঠশাশুড়িদের কাছে ওঁদের বাড়ির রীতকরণ সব শিখে নিত, উপেনরা দুভাই যেমন মেসে
আছে থাকত। চম্পাহাটি তো এই একবেলার
রাস্তা, জামাই শনিবার অফিস সেরে বিকেল করে চলে গেলে রাত গভীর হওয়ার আগেই পৌঁছে
যাবে, তারপর রোব্বারটা থেকে সোমবার কাকভোরে বেরিয়ে এলেই অফিস ধরতে পারবে
সময়মত। যদিও শুনেছেন বেয়ান বেয়াইই জামাইকে
বলেছেন বাড়ি নেবার কথা, তবু প্রমদার মনটা খুঁতখুঁত করে – কে জানে এর পেছনে কোন
সুক্ষ্ম পরিকল্পনা আছে কিনা বেয়াইদের!
প্রমদা ঢুকতে ঢুকতেই দেখলেন জামাই
সাইকেল ঢুকিয়ে একতলার বারান্দার কোণের
দিকে একটা ঘরের জানলার শিকের সাথে চেন দিয়ে বেঁধে লক করে রাখছে। নতুন ফিলিপস সাইকেল, প্রমদা নিজে পছন্দ করে জামাইয়ের জন্য
কিনেছিলেন। কোম্পানি যে লেখে ‘সম্পূর্ণ বিলাতে তৈরী’ সে ঠিকই লেখে, কেমন পোক্ত
রড হ্যান্ডেল সব, কালো চকচক করছে। প্রমদার ইচ্ছে হল একবার সাইকেলটার গায়ে চুপি
চুপি হাত বুলিয়ে নিতে। নিজের তো হল না,
থাক কদিন পরে সিংজির দেনা হালকা হলে, খোকন কলেজে উঠলে নাহয় ওকেই কিনে দেবেন।
সাইকেল থাকলে একটা, ট্রাম বাসের পয়সাও
বাঁচে আর নিজের খুশীমত সময়মত ঘোরাফেরাও করা যায়। উপেন সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়েই প্রমদাকে দেখতে
পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পৌষের সন্ধ্যে,
৫টা বাজতেই অন্ধকার হয়ে যায়, আর এ
তো আরো আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট পার হয়েই গেছে। অন্ধকারে ঠাহর করতে একটু সময় লাগে,
তার মধ্যেই প্রমদা বলে ওঠেন ‘বাবাজি কি এই ফিরছ?’ এবার চিনতে পেরে উপেন সসম্ভ্রমে বলে ‘হ্যাঁ এই তো। আসুন এইদিকে।’ ‘বাবা’ ডাকটা এখনও তেমন রপ্ত হয় নি মুখে, মনে মনে একটু লজ্জিত হয় তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে
উঠতে উঠতে মা’কে ডাক দেয়। বেয়ান খুশী হয়েই অভ্যর্থনা করেন।
মনে মনে হয়ত প্রস্তুতই ছিলেন তাই কিছু শুকনো নোনতা মিষ্টি খাবার জলখাবারের
রেকাবীতে সাজিয়ে আনেন। প্রমদা একটু আপত্তি করেন, বেয়ান তাতে বলেন ঝুনুর
পুত্রসন্তান না হওয়া অবধি যে প্রমদা এ বাড়িতে অন্নগ্রহণ করবেন না তা তিনি জানেন্
কিন্তু শুকনো খাবারে তো দোষ নেই। প্রমদা বলেন সন্ধ্যাহ্নিক হয় নি, বাড়িতে সবাই
অপেক্ষা করবে। এবার উপেন সংকোচ কাটিয়ে বলে ‘বাবা আপনি হাত মুখ ধুয়ে নিন, কাচা
ধুতি দিচ্ছি আমি। গোপু গিয়ে ওবাড়িতে বলে আসছে।‘ এদের আন্তরিকতায় প্রমদা আর আপত্তি করতে পারেন
না, হাত মুখ ধুয়ে উপেনের দেওয়া ধুতি পরে সন্ধ্যাহ্নিক সেরে জলযোগ করেন। বেয়াইয়ের খবরাখবর নেন, কবে নাগাদ
ফিরবেন? উপেন জানায় তার বাবা জ্যাঠারা সব বিক্রিবাটা লেনদেন চুকিয়ে আসতে গেছেন,
কবে আসবেন বলা যায় না। বলতে গিয়ে মুখের উপর দিয়ে
দুশ্চিন্তার একটা ছায়া খেলে যায়। প্রমদা বোঝেন, ওপারের অবস্থা, বিশেষত
বর্ডারের অবস্থা খুব খারাপ। আর গুজবও তো শোনা যাচ্ছে কতরকম।
স্থান – কলকাতা কাল – ১৯৫০ সাল জানুয়ারী মাস
৩
-
খোকন এখন কদিন ইস্কুলে যাচ্ছে না,
সামনেই ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা। টুনুও দেবে খোকনের সাথেই পরীক্ষা। প্রমদার শরীর
একদম ভাল যাচ্ছে না, ঝুনুর বিয়ের পর থেকেই
নানা অসুখ লেগেই আছে। সরলা ভাবেন এই বাড়িটারই দোষ আছে কোন, টুনুটা এরকম জন্মের মত খুঁতো হয়ে গেল, কী করে যে
বিয়ে থা হবে! তাও যদি মুখখান তেমন পরীর মত হত, রঙটা ফর্সা হত তবু একটা আশা ছিল। আর
রঙ নিয়ে কিইবা বলবেন সরলা, এক বড়মেয়ে ছাড়া একজনও তো তেমন পরিস্কার রঙ পায় নি,
সকলেই তাঁর মত চাপা। খোকন তো বেশ কালো, তা ব্যাটাছেলের আর রঙ কি দরকার। ঝুনু তো কোনওরকমে পার হয়েছে, এখন টুনুকে নিয়ে
কী করা যায়! অনেক পয়সাকড়ি থাকলে নাহয় জামাই একটা যোগাড় হয়েই যেত। সরলা ভাবেন এক একবার প্রমদাকে জিগ্যেস করবেন
ভাসুরঠাকুর কিছু টাকাকড়ি দেবেন কিনা। তাঁর শাশুড়ির অত গয়না, সেও তো কয়েকখানা তাঁর
পাবারই কথা। কি যে হল! সেই একদিন প্রমদা
গেলেন, ফিরে এলেন যেন কত বড় বিপর্যয় ঘটে
গেছে এমন চেহারা নিয়ে। তখন মানুষটার চেহারা, হাবভাব দেখে সরলা আর বেশী কিছু
জিগ্যেস করেন নি, প্রমদা সংক্ষেপে শুধু বলেছিলেন ওদিকে কোন সুবিধে হবে না এই নিয়ে
আর কিছু জিগ্যেস কোরো না। তা সে সম্বন্ধটাও ভেঙেই গেল। এখন যাহোক ঝুনুর বিয়েটা
ভালই হয়েছে মনে হয়। ঝুনু আসে তা সপ্তাহে অন্তত একদিন তো বটেই। সরলাও গেছেন বার দুই তিন। বেয়ানকে বেশ লেগেছে
তাঁর। তিনি তো কখনও প্রমদাকে ছেড়ে খুব একটা থাকেন নি, বেয়াই দেখো কেমন সুন্দর
ওদেশে গেছে আর উনি দিব্বি এদিকে জা’য়েদের সঙ্গে একসাথে সংসারটাকে ধরে রেখেছেন। জগুবাজারের বাসাও গুছিয়ে গাছিয়ে দিয়ে ফেরত চলে গেছেন, ঝুনুই চালাচ্ছে স্বামী আর
দেওরকে নিয়ে। মাঝে একবার তিনজনে গিয়ে চম্পাহাটি থেকে ঘুরেও এলো। এদিকে আজ আবার
রুনুর আসার কথা আছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। রুনুর আবার বাচ্চা হবে তাই এখন কদিন এখানেই।
কাছেই মাতৃসদন, আগেরগুলোও ওখানেই জন্মেছে।
নির্বিঘ্নেই হয়ে গেছে, আশা করা যায় এবারেও তাই হবে। তবু বলা তো যায় না
কিসের থেকে কি হয়ে যায়, সরলা তাই কালীঘাটে মানত করে রেখেছেন ৫ টাকার মিষ্টি, শাঁখা
সিঁদুর শাড়ি দিয়ে মায়ের পুজো দেবেন। ইচ্ছে তো করে একবেলার ভোগ নিবেদন করতে, কিন্তু
অত খরচের সাধ্য তাঁদের নেই।
খোকন একমনে বসে নতুন ঝর্ণা কলমটায়
কালী ভরছিল। বেশ দামী, বারবার দোয়াতে
ডোবাতে হয় না, একবার ভরে দিলে অনেকদিন চলে, এই কলমটা মেজদি কিনে দিয়েছে, আসলে
জামাইবাবুই কিনে এনেছে মেজদি হাতে করে দিল। মেজদির বিয়ের সময় আসা লোকজনের মধ্যে
কেউ কোথা থেকে একটা সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকা এনে ফেলে গিয়েছিল। তার মধ্যে ‘মেন্টমোর অটো-ফ্লো ফাউন্টেন
পেন –ইংল্যান্ডে প্রস্তুত মূল্য ১৫/-‘ বিজ্ঞাপনে পেনটার ছবি দেখে
অবধি খোকন চোখ ফেরাতে পারে নি। বারবার খুলে খুলে দেখত, শেষে যখন দেখল কেউ আর বইটার
খোঁজ করছে না, তখন সাবধানে বিজ্ঞাপনটা কেটে
ইতিহাস বই কেউ খুলবে না এই ভেবে বইয়ের
মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। মেজদি যখন দ্বিরাগমনে এল, কবে যেন ওর বইখাতা গোছাতে গিয়ে দেখে
ফ্যালে। ওকে কিছু বলে নি, হঠাৎ গতকাল মেজদি এসে হাতে দিল। মা তো প্রথমে
ভীষণই আপত্তি করেছিল, বাবা খুব রাগ করবে ---শেষে
জামাইবাবু বলতে তবে মানল। বাবা অবশ্য এমনি কিছু বলে নি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে
শুধু বলেছিল ‘দেখিস হারাস না আর এত দামী কলমে লিখে উপযুক্ত রেজাল্ট হয় যেন।‘ ছোড়দি এসে দুইবার দেখে গেছে, আজ আবার বড়দিরাও আসবে, যত্ন করে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দেবে বরং,
বড়দির ছেলেটা যা দুষ্টু, যা হাতের কাছে পায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে কেবল। কালিভরা হলে সাবধানে ন্যাকড়া দিয়ে নিবের চারপাশ
মুছে নিয়ে ঢাকনি আটকে কলমটাকেও একবার ন্যাকড়ার কালি না লাগা পরিস্কার দিকটা দিয়ে
মুছে উঠে দাঁড়াতেই দেখল টুনু কখন যেন নিঃশব্দে এসে একটু দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ওকে তাকাতে দেখে চাপা গলায় বলল ‘আমাকে একবার দে না রে দেখি’। ভীষণ রেগে উঠতে গিয়েও থমকে
গেল খোকন। কি করুণ
চোখে একভাবে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে
আছে ছোড়দিটা। ওকে কেউ ভাল কলম কিনে দেবে এমন আশা বোধহয় ও নিজেও করে না, আগে প্রত্যেকবার বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোবার দিন
বাবার চাপা গলায় তর্জন কানে আসত, এখন আর কেউ তেমন কিছু আশাই করে না। তাই ছোড়দি যখন
এইবার ক্লাস নাইনে উঠে গেল, বাবা আর তেমন কিছু বলে নি, হয়ত বা একটু অবাকই হয়েছিল।
খোকন মনে মনে দ্রুত ভেবে নেয় কলম তো সবসময় সঙ্গে নিয়ে ঘোরা সম্ভব না, যদিও
পরীক্ষার বছর তবু বিকেলে একবার একটু খেলতে
কি আড্ডা দিতে বেরোয়, তাছাড়া মাঝে মাঝে মা’য়ের ফাইফরমাশ খাটতে দোকানে যায় কি জামুকে
ডাকতে যায়। সেইসময় ছোড়দি যদি নজরে রাখে কলমটা তাহলে ভালই হয়। একমুখ হেসে হাত
বাড়িয়ে দেয় ‘দ্যাখ। সাবধানে ধরিস, নে এই কাগজটায় দুটো একটা শব্দ লিখে
দেখ।‘
৪
-
রুনুদের আসতে আসতে সন্ধ্যে গভীর
হয়ে গেল। ঝুনু বলেছিল পারলে আজই একবার আসবে বড়দির সাথে দেখা করতে। এখনও আসে নি যখন আজ আর আসবে না বলেই মনে হয়,
জামাইয়ের ফিরতে আজ দেরী হচ্ছে নির্ঘাৎ।
রুনুর দুই মেয়ে এক ছেলে, আরেকটি পেটে, মনে হচ্ছে হয়ে যাবে দিন দশ পনেরোর মধ্যেই। দেওর আর জা’য়ের সাথে রুনু এল, চলাফেরা
করতে কষ্ট হচ্ছে দেখেই বোঝা যায়। সরলা উদ্বিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করেন ‘কিসে এলি রে? জামাই এল না?’ কেউ কিছু বলার আগেই বড় মেয়ে
কুটু বলে ওঠে ‘ট্রামে করে এলাম দিম্মা,
ফাসক্লাসে চড়ে, জান তাতে অ্যাত্ত বড় পাখা ঘোরে।‘ ছোট মেয়েও লাফিয়ে নেচে
একপাক ঘুরে বলে ‘ফাকা ঘোয়ে ইম্মা।’ দেওর বৈঠকখানায় বসে বসেই বলে ‘দাদার আজ কাল একদম ছুটি নেই, পরে আসবে। মাওঐমা আমরা কিন্তু
এখন বসব না, রাত হয়ে আসছে এতটা পথ আবার যেতে হবে।‘ সরলা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন ‘ও কি কথা এক্ষুণি যাবে কি,
একটু হাতে মুখে জল দাও।‘ এবার রুনুর জা’ও বলে ‘না মাওঐমা, শিবপুর অনেকটা পথ, জানেনই তো। শুনছি নাকি আবার
গন্ডগোল লাগছে পিলখানার দিকে।’ জলখাবার মোটামুটি তৈরীই ছিল হিঙের কচুরি, আলুর তরকারি আর জগুবাজারের
ভীমনাগের দোকানের তালশাঁস সন্দেশ একটা করে --- কুটুম মানুষ, অন্তত এইটুকু না করলে
ভাল দেখায় না। বিকেলের জন্য উনুনে আঁচ
ততক্ষণে ধরেই গেছে, টুনু তাড়াতাড়ি
উনুনটা ওপরে এনে হিঙের কচুরি ক’খানা বেলে নিয়ে ভাজতে নেয়,
সরলাও এসে হাত লাগান, টুনু অত চটপটে নয় ঝুনুর মত। বাচ্চাগুলো ততক্ষণে
খোকনের ঘাড়ে পিঠে চড়ে, লাফালাফি করে খেলছে। রাত আটটার দিকে সব গেলে সরলা রুনুকে নিয়ে বসেন,
নারকেল তেল ঘষে ঘষে মাখিয়ে যত্ন করে একটা খোঁপা করে দেন। কাল বাদে পরশু মেয়ের সাধ
দেবেন, ন’মাসে সাধ দেয় ওঁদের।
টুকটাক কথা হয়, খবরাখবর নেওয়া, রুনু বারেবারে জিগ্যেস করে ঝুনু কেমন সংসার
করছে নিজের আলাদা সংসারে? বিয়ের একমাসের
মধ্যেই নিজের সংসার পেয়ে গেল – রুনুর কথায় খানিকটা যেন দুঃখের ভাব, অল্প একটু জ্বালাও কি?
সরলা কথা ঘোরাতে জামাইয়ের খবর জিগ্যেস করেন। রুনু ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে ‘ভাল তো, ভাল আছে সব। শরীরটা খারাপ লাগছে মা, একটু
শুই গিয়ে।‘ সরলা বাধা দেন না,
একটু খটকা লাগে মেয়ে কি কিছু গোপন
করতে চাইছে?
রুনুর সাধের দিনটা বৃহষ্পতিবার
হলেও ছুটির দিন পড়েছে। স্বাধীন ভারতের প্রথম ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’এ ছুটির ঘোষণা করা হয়েছে।
ইস্কুল কলেজ আপিস কাছারি সবই বন্ধ, তবে দোকানপাটও বেশিরভাগ বন্ধ থাকবে যা শোনা
গেছে। তাই বাজারটা আগেই করে রেখেছেন প্রমদা, খোকনকে সঙ্গে নিয়ে। বাসট্রাম কি চলে
না চলে তাই রুনুর শ্বশুরবাড়ি আর ঝুনুদের
আগের দিন বিকেলেই এসে রাত্রিবাসের নিমন্ত্রণ করে রেখেছিলেন প্রমদা। এমনিতে এসব মেয়েলি অনুষ্ঠানে পুরুষদের উপস্থিতি
খুব একটা পছন্দ করেন না প্রমদা, নিজেও যান না সাধারণত, তবে রুনুর জামাই অনেকদিন
সেই ঝুনুর বিয়ের পর থেকে আর আসেও নি আর
মেজজামাই এত কাছে থাকে --- কাজেই দুই জামাই আর তাদের ভাইদের নিমন্ত্রণ করে এসেছেন।
তা শুধু ঝুনু ছাড়া কেউ আসে নি, সবাই সকালে চলে আসবে। ওদিকে অনিলাবালাও এসেছেন। অনেকদিন বাদে তিনবোনে
আবার একসাথ, কাজের বাড়ি হলেও বিয়ে তো আর নয় তাই সকলেই একটু গা ঢিলে দিয়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ একদিনের জন্য মোক্ষদাকে রাখা হয়েছে রান্না আর বাসনমাজায় সাহায্য
করার জন্য। শোভাদিদিও এসে সরলাকে টুকটাক
এটা সেটা বলে দেখেশুনে যাচ্ছেন। বড়জামাই এসে গেল বেলা এগারোটার মধ্যেই। এত কাছে উপেন আর গোপেন, বেলা
দুটো আড়াইটে বেজে গেল তখনও তাদের দেখা
নেই। আস্তে আস্তে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে, এর মধ্যে বারবেলা
লাগার আগেই শুভ সময় দেখে রুনুর সাধভক্ষণ হয়ে গেছে। প্রমদা যখন প্রায় ঠিকই করে ফেলেছেন এবার গিয়ে
দেখে আসবেন কি ব্যপার, তখনই গোপেন একা এসে
উপস্থিত। জানা গেল কাল ঝুনু এইবাড়িতে চলে
আসার পর চম্পাহাটি থেকে জরুরী তলব আসে। উপেন তখনই রওনা দেয় যাতে যতরাতই হোক গিয়ে
পৌঁছাতে পারে। গোপেনকে বলে যায় বেলা দুটোর
মধ্যে উপেন না ফিরলে সে যেন একাই
নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চলে যায়। এইবার
উপস্থিত পুরুষরা সবাই খেতে বসে যায়। খেতে খেতে টুকটাক আলোচনা চলে, বড়জামাই একটু
অসন্তুষ্ট, এই যে ভারত ‘জনগণ প্রজাতন্ত্র’ হল এতে ঠিক কী সুবিধেটা হবে! ১৯৩৫ সালের
গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট দিয়ে তো দিব্বি চলছিল। ঝুনু খেয়াল করে দ্যাখে গোপেন কি যেন বলতে গিয়েও
থেমে গেল, কিছুটা অন্যমনস্ক। ঝুনু অবাক হয়। গোপেন তো এমন চুপচাপ ছেলে নয়,
বিশেষত ভারতের স্বাধীনতা, সরকার, তার নানা
নিয়ম কানুন নিয়ে নিজে তো উৎসাহী বটেই,
অন্যের সাথে আলোচনা করতেও ভালোবাসে। ঝুনুর এইবার একটু খটকা লাগতে থাকে। এদিকে শ্বশুর জেঠশ্বশুরদের ফেরার সময় হয়ে গেছে অন্তত
এক সপ্তাহ আগেই, কোন খবর নেই। ওদিকে কি
এমন জরুরী ব্যপার যে একেবারে হন্তদন্ত হয়ে
উপেন্ চলে গেল, গোপেনও ঠিক যেন নিজের
মধ্যে নেই!
৫
-
সরলা আজ জামুকে খেতে বলেছিলেন,
ছেলেটা আসে কাজ করে দিয়ে একবেলা খেয়ে চলে যায়, পয়সাকড়ি চায়ও না, উনিও দেন না, মনে
মনে একটু অপ্রতিভ লাগে বৈকী। এই তো ঝুনুর
বিয়েতে বাইরের কাজকর্মে প্রচুর সাহায্য করেছে।
জামু এল বেলা প্রায় চারটে নাগাদ। খুব ভয়ে ভয়ে কড়া নাড়ছে, জানে প্রমদা আজ
বাড়ি আছেন, আছেন আরো অনেকে। তা ততক্ষণে সবার খাওয়া হয়েই গেছে, টুনুকে সিঁড়ির কাছে
দাঁড়িয়ে খেয়াল রাখতে বলেছিলেন। টুনু
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোকনের কলমটার কথাই ভাবছিল, কেমন তরতরিয়ে লেখা হয়, কলমটা যেন কাগজের উপর দিয়ে জলের মত বয়ে যায়। আহা ওরকম একটা কলম ও বড় হয়ে
কিনবে। জামু আস্তে করে কড়াটা নাড়তেই টুনু
নেমে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকায়। জামুকে দেখলে টুনুর মনে হয় ইতিহাস বইয়ের খানিক টুকরো যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। কতরকম অজানা সব
গল্প যে বলে। সরলা নেমে দেখেন ছেলে বেশ পরিস্কার শার্ট প্যান্ট পরে ভব্যিযুক্ত হয়ে এসেছে। খাবার বেড়ে সামনে বসে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলেন এও আজ একটু অন্যমনস্ক। হুঁ,
হাঞ্জি আর ঘাড় নেড়েই কাজ চালাচ্ছে। ওর
হিন্দিবাংলা মেশানো তড়বড়ে কথা আজ নেই। খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে, থালা গেলাস মেজে ধুয়ে
রেখে কিছু কাজ আছে কিনা জিগ্যেস করে তারপর ইতস্তত ভাবে জানায় ওর একটা আর্জি আছে মা’জির কাছে। ঢোলা শার্টের পকেটে
হাত গলিয়ে তুলে আনে একটা কাগজে মোড়া পাতলা কি যেন। ঐ জিনিষটা সে সরলার কাছে রেখে যেতে চায়, ওর
থাকার কোন ঠিক নেই, এটা আরেকজনের জিম্মা করা জিনিষ, চুরি হয়ে গেলে উপরওলার কাছে
অপরাধী হয়ে যাবে জামু। সরলা বলেন যার জিনিষ
তাকেই দিয়ে দিলে তো হয়। জামু নাকি জানেই না সে মানুষ কোথায়।
আবার ওর মুখ থমথমে হয়ে যায়, চোখদুটো কেমন অচেনা। আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরলা আর জিগ্যেস করতে সাহস পান না --- অথচ
কী জিনিষ, কার জিম্মা এগুলো না জেনে রাখা
ঠিক হবে না --- চিন্তায় পড়ে যান। ওঁর
ইতস্তত ভাব দেখে জামু কাগজটা খুলে সামনে বাড়িয়ে ধরে। সরলা অবাক হয়ে দেখেন একটা রূপোর তৈরী পাতলা ছোট্ট কেস, উপরে সুক্ষ্ম
লতাপাতা খোদাই করা। ঢাকনার জোড়টা এত মসৃণ যে প্রায় বোঝাই যায় না,
মনে হয় একটাই রূপোর পাত বুঝি বা। হাতে নিয়ে দেখেন খুব হালকা, একটা বালা কি কঙ্কনের
এর থেকে বেশী ওজন হবে। একদিকে জোড়ের
মাঝামাঝি সুক্ষ্ম একটু ভাঁজমত,
সেখানে নখ দিয়ে হাল্কা চাপ দিতেই ঢাকনা খুলে গেল, ভেতরে সারি সারি ছয়টা খাঁজকাটা।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন সরলা, কি এটা? জামু জানায়
সুট্টা রাখার বাক্স, বুঝতে পারছেন না দেখে
মুখের সামনে হাত এনে আগুন ধরিয়ে টানার ভঙ্গী করে।
বিরক্ত হয়ে বলেন অ বিড়ি রাখার আবার এত ঢং! জামু জোরে জোরে ঘাড় নাড়ে ‘নহি নহি বিড়ি নহি বিলাইতি
সুট্টা, বহোত ম্যাহেঙ্গা, সায়েবলোগ পিতে হ্যায়।‘ সরলা বিরক্তির সাথে বলেন ‘বুঝেছি, ঐ হল বাপু, তা তুই
পেলি কোত্থেকে রে? কার এটা?’ মনে মনে ভাবেন হয়ত ওরই বাবা ঠাকুর্দা কারো জিনিষ, ওরা তাহলে বেশ ধনীই ছিল। জামু বলে না এটা পাজনিগারা
সাহেব দিয়ে গেছেন। দিল্লীতে ওর সাথে দেখা হয়েছিল সাহেবের। পাজনিগারা সাহেব করাচী
থেকে পালিয়ে কোনমতে জাহাজ ধরে বুম্বাই এসে
অপেক্ষা করছিলেন, ওঁর পরিবারের সবাই হয়ত
পরের কোন জাহাজে আসবে। এর মধ্যে বুম্বাইতে খুব ঝামেলা লেগে যায় সেখানে তেমন নিরাপদ
থাকার জায়গা না পেয়ে টিরেন চেপে দিল্লী
এসেছেন, এখানে কোথাও তাঁর চাচাজির রিস্তেদাররা
থাকে। তিনি খুঁজে পেলে সেখানে উঠে সুঁই ধাগা নিয়ে আবার জীবনটা বানাবেন। ততদিনে
পরিবারের লোক এসে গেলে তারা খুঁজে পাবে কী করে, তাই জামুকে এটা দিয়ে বলেন স্টেশানে
কাউকে যদি দেখে অবিকল পাজনিগারা সাহেবের মত দেখতে শুধু বুডঢা হয়ে বাল সফেদ হয়ে
গেছে, তাহলে বুঝবে ওইই ওঁর পিতাজি আছেন। ওঁদের সঙ্গে সিল্কের সেলোয়ার কুর্তা
পেহনকে খুব সুন্দরী তিনজন আওরত আর পাঁচটা ফুটফুটে বাচ্চালোগ থাকার কথা। আর একজন খুব হট্টাকট্টা যোয়ান, ওঁর
ছোটভাই, যে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছে। এই
বাক্সটা ওঁর পিতাজির জানসে পেয়ারা চিজ, এইটে বড়ছেলের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে
জিনিষটার কোন ক্ষতি না হয়। জামু ওঁদের এই
কেসটা দেখালেই ওঁরা বুঝবেন জামু পাজনিগারার লোক। জামু ওঁদের সঙ্গে করে নিয়ে আসবে, দুই একদিন রাখবে কোথাও, অথবা
ওঁদের সাথে গিয়ে দেখে আসবে কোথায় থাকছেন। পাজনিগারা সপ্তাহে দুদিন জামা মসজিদের
সামনে যে অন্ধা ভিখারি গানা গায় তার সামনে এসে জামুর সাথে দেখা করবেন। জামু যেখানেই থাকুক মঙ্গল আর শুক্রবার যেন জামা
মসজিদের সামনে চলে আসে। তারপর তো জামুদের
দিল্লী থেকেও পালাতে হল। সেই থেকে সঙ্গেই রেখেছে, কিন্তু আর নিজের কাছে
রাখতে সাহস হচ্ছে না। সরলাদের বাড়িতে
নিরাপদে রক্ষিত থাকবে, পাজনিগারাদের কাউকে দেখলেই জামু নিয়ে যাবে।
জামু যাবার পরে আরো প্রায় আধঘন্টা
কেটে গেছে, সরলা আর প্রমদা শোবার ঘরের
একপাশে বড় কাঠের দেরাজের সামনে মুখোমুখী
বসে আছেন চুপ করে। উপরে এসে বৃত্তান্ত
জানানোয় প্রমদা কিছু না বলে কাঠের দেরাজের ভেতরে ছোট খুপরিতে জিনিষটা ঢুকিয়ে রাখতে
গিয়ে হঠাৎই কেমন গলায় বলে ওঠেন ‘কার ধন কে রাখে!’ তারপর ভেঙে পরে বাক্সের উপরের কারুকার্য্যে হাত বোলাতে
বোলাতে এতদিন বাদে খুলে বলেন কৃষ্ণকান্তের বাড়িতে গিয়ে যা যা হয়েছিল, যা এতদিন
কাউকেই বলেন নি সেই সব খুঁটিনাটি। কোনও এক ‘পাজনিগারা’দের টুকরো হয়ে যাওয়া পরিবারের জোড়া লাগাবার পৈত্রিক
সম্পদটি খুলে দেয় হাজার হাজার মাইল দূরের আর একটি পরিবারের যাবতীয় পৈত্রিক
সম্পদ ও উত্তরাধিকার থেকে ছিন্ন হয়ে যাবার গোপন ক্ষতমুখ।
টীকাঃ
১) পাজনিগারা – পারসিক পদবী। মূলতঃ দামী
সিল্কের সুতো দিয়ে সুক্ষ্ম রেশমবস্ত্র বয়ন এঁদের কৌলিক ব্যবসা।
২) কৃষ্ণকান্তের বাড়ি যাওয়া ও প্রত্যাখ্যান
– এই ঘটনাটি ধারাবাহিকের চতুর্থ পর্বে আছে।
আবারো অনবদ্য এক এপিসোড শেষে পরের কিস্তির অপেক্ষার শুরু।
ReplyDeleteভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা সই।
Delete