খোঁজাখুঁজি

Sunday, August 5, 2018

সিজনস অব বিট্রেয়াল – অষ্টম পর্ব

প্রথম পর্ব   দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব   চতুর্থ পর্ব  

পঞ্চম পর্ব   ষষ্ঠ পর্ব   সপ্তম পর্ব     অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব 




সিজন-১ (কন্টিন্যুড)
স্থান কলকাতা   কাল ১৯৪৯ সাল নভেম্বর মাস

-
শীতটা বোধহয় এবার একটু তাড়াতাড়িই পড়ে গেল,  গায়ের আলোয়ানটা  ভাল করে জড়াতে জড়াতে ভাবেন রমেশ, আজ আর  সন্ধ্যে করে অফিসের দিকটায় যাবেন না। অফিস বললে অফিস, চেম্বার বললে চেম্বার, দমদমা জেলের মূল অফিসের লাগোয়া বারান্দায়ই একটেরে ঘর তাঁর। তাতে অফিসের কাজ করবার জন্য  টানা দেরাজওয়ালা  বড় টেবিল যেমন আছে, তেমনি একদিকে পর্দা ঘেরা একটা  বিছানা আর হাত ধোবার ছোট একটি বেসিন, একটা   কাচের আলমারিতে অত্যাবশ্যক কিছু ওষুধ, বিস্তারিত পরীক্ষা করবার কিছু ডাক্তারি উপকরণও আছে। জেলের হাসপাতালটি অবশ্য ভেতর দিকে। সেখানেও তাঁর বসবার ঘর একটি আছে, তবে সেখানে বসার সুযোগ তাঁর তেমন  হয় না।  সকালে একবার হাসপাতালে রাউন্ড দিয়ে আসেন, পরীক্ষা নীরিক্ষা মূলতঃ তখনই সেরে ফ্যালেন। যে কটি কয়েদী ছোটখাট জ্বর, পেটখারাপ জাতীয় সমস্যা নিয়ে আসে, তাদের এই অফিসঘরেই দেখে ওষুধপত্র দেন। সশ্রম দন্ড পাওয়া কয়েদীরা অনেকসময় কিছু একটা অসুখের ছুতো ধরে  তিন চারদিন হাসপাতাল বাসের অনুমোদনপত্র লিখিয়ে নিতে চায়।  সেইসব ক্ষেত্রে জেল-সুপারের কাছাকাছি ঘরে ডেকে পরীক্ষা করার,  উঁচুগলায় শারীরিক সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ জিজ্ঞাসাবাদ করার কিছু মনস্তাত্ত্বিক সুবিধে আছে, ঘাগু অপরাধী না হলে একটু অসুবিধে বোধ করে, উত্তর দিতে গিয়ে থমকে থমকে যায়, সেজন্যই আরো এই ব্যবস্থা। সকালে আজ খুব চাপ গেছে। একে তো নতুন রিক্রুট এসেছে প্রায় জনা সতেরো ছেলে মেয়ে মিলিয়ে। জেলের খাতায় নাম উঠেই গেছে কাল, তবু সকলের মোটামুটি একটা পরীক্ষা করে নেওয়া,  জেলে ঢোকার সময় কেমন স্বাস্থ্য ছিল, কিছু রোগ ছিল কিনা এসবের একটা বিবরণী লিখে  রাখা,  এগুলোও তাঁর কাজের মধ্যেই পড়ে। ওদিকে আবার  আজই কাঠের কাজ করতে গিয়ে একজনের হাত প্রায় দুইফালা হয়ে গেছে, তার হাত সেলাই করে হাসপাতালে ভর্তি করে কী কী করতে হবে তা কর্মীদের বুঝিয়ে আসতে আসতে তাঁর বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে।  এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে উঠতে না উঠতেই সন্ধ্যে প্রায়। থাক আজ, জরুরী কিছু থাকলে ওরা খবর পাঠাবেখনে।

বাবাকে বৈঠকখানায় আরাম করে বসতে দেখে পারু আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ায়, জিগ্যেস করে চা আনব বাবা? রমেশ বলেন আন, একটু আদা দিস রে গলাটা কেমন খুসখুস করছে। পারু ঘাড় নেড়ে দৌড়ে চলে যায়। রমেশ নতুন প্রবাসীখানা নিয়ে বসেন। চা নিয়ে আসেন অমলাশশী, সাথে কাঁসার রেকাবে কখানা ভাজাভুজি।  ভাজা দেখে ভুরুতে হালকা ভাঁজ পড়ে রমেশের, দুটো রেখে বাকীগুলো নিয়ে যেতে বলেন, একে অবেলায় খাওয়া হয়েছে, এখন আর এসব খেতে চান না, বয়স বাড়ছে সতর্ক থাকা ভাল।  পারুকে ডেকে আর একটা রেকাবী আনতে বলে উলকাঁটা নিয়ে গুছিয়ে বসেন অমলা। অমইর‍্যা বাড়ি নাই? জিগ্যেস করেন রমেশ। বড়দায় মীর্জাপুর স্ট্রীট গ্যাসে, রাইত হবে আসতে পারুই উত্তর দেয় তড়বড়িয়ে। নিশ্চিন্ত হন রমেশ। ছেলেকে বলেছিলেন ভাইপোদের খবর নিয়ে আসতে আর এখানে একবার ঘুরে দুদিন থেকে যাবার কথা বলতে। অমলা জিগ্যেস করেন, ছোটঠাকুরপো কিছু খবর দিয়েছে? আসবে এদিকে? রমেশ বলেন এই ত সামনের মাসে শীতের ছুটি পড়বে কোর্টের তখনই আসবে। বারাকপুর কোর্টে উমেশের পশার ভালই। তার ছেলেমেয়েগুলি ছোট ছোট এখনও, ওখানেই ইস্কুলে পড়ে।  অমলার বাপের বাড়ির সকলেই এদেশে এসে গেছেন, এমনিতে ওদিকে তাঁদের তেমন কিছু জমিজিরেত ছিলও না। তাঁর পিতা  অমলার বিয়ের বহুবছর  আগেই গত হয়েছেন, যা সামান্য কিছু  জমিজমা ছিল তা বিক্রি করে করেই  তাঁদের ভাইবোনেদের লেখাপড়া, বিয়ে সবই হয়েছে। ১৯৪৭ সালের মার্চ নাগাদ যেই রটল ইংরেজরা চলে যাবে আর পাকিস্তান আলাদা দেশ হবে, তখনই অমলার দাদা ভাইয়েরা বাড়ি বিক্রি করে মাকে নিয়ে কলকাতা আসে প্রথমে।  এরপর তো  রটে গেল কলকাতাও পাকিস্তানে চলে যাবে, সে কি অস্বস্তি আর আতঙ্ক চতুর্দিকে।  এর মধ্যে বড়দা চাকরি পেলেন বেরিলি  আর মেজদা বম্বেতে।  মাকে বড়দা  নিয়ে গেলেন আর মেজদার সাথে ছোট ভাইটা গেল ওখানেই কিছু হাতের কাজটাজ শিখবে। দিনেদিনে যা চাকরির বাজার হচ্ছে কিছু হাতের কাজ না জানলে আদৌ কোন চাকরি পাবে কিনা কে জানে! অমলার তাই আর বাপের বাড়ি যাওয়া হয় না তা আজ প্রায় দুই বচ্ছরের ওপর হয়ে গেল।  ওসব জায়গাতেও গোলমাল দাঙ্গা হয়েছে  রমেশের কাছে শুনেছেন তা। তবে ওরা সবাই নিরাপদেই আছে, গত সপ্তাহেও পোস্ট কার্ড এসেছে মার কাছ থেকে। যাক বাবা ঠাকুর ঠাকুর করে সবাই ভাল থাক তাহলেই খুশী অমলা। 

-
পারু অঙ্ক খাতা আর বই নিয়ে এসে কাঁচুমাচু মুখে আস্তে করে ডাকে বাবারমেশ তাকিয়ে ব্যপার বুঝে প্রথমে একটু বিরক্ত হয়ে উঠলেন। আশ্চর্য্য এইবারে ম্যাট্রিক দেবে মেয়ে এখনও তার অঙ্ক দেখিয়ে দিতে হবে? আর এইটুকু কাজও অমরেশ করতে পারে না? এই ত আজই এবেলা যান নি কাজে, নাহলে রোজই তো রাত নটার পর বেরোন তিনি, বাড়ি আসতে আসতে সাড়ে নটা বেজেই যায়। এইটুকুও বিশ্রাম নেবার জো  নেই গো!  তাঁর মুখে ফুটে ওঠা অসন্তোষ, ভুরুর কোঁচ দেখে পারুলের মুখ শুকিয়ে এইটুকুনি হয়ে যায়, আর না এগিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কি যেন বলে সে। রমেশ জিগ্যেস করেন দাদাকে দেখাস নাই? আর ইস্কুলের টিচারগুলা করেই বা কি! রোজ রোজ এতসব বাড়িতে দেখাইতে হয়? প্রায় শোনা যায় না, এমন স্বরে পারু বলে দাদা তো কলেজ থেকে আর বাড়ি আসে নি, এই অঙ্কগুলো আজই দিয়েছে ইস্কুলে, কাল করে নিয়ে যেতে হবে। রমেশ হাতের ইশারায় মেয়েকে কাছে ডাকেন। এইবার অমলা মুখ খোলেন, বলেন ও তো অঙ্ক নিতেই চাই নাই,  ইতিহাস আর গার্হস্থ্য বিজ্ঞান নিয়ে পড়লে ও নিজেই পারত। আপনেই তো জোর করে অঙ্ক দিলাইন। তা ঠিক অবশ্য। শুধু পারুল কেন, অমরেশও সপ্তম শ্রেণীতে উঠেই অঙ্ক ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু রমেশ কিছুতেই সম্মত হন নি। অমরেশকেও নিয়মিত অঙ্ক দেখাতে হত তাঁর। ম্যাট্রিকে অঙ্কের নম্বর বেশ কমই ছিল, ম্যাট্রিকের  পরে ছেলে আর কিছুতেই অঙ্ক নিয়ে পড়তে চায় নি,  তিনিও আর জোর করেন নি, ছেলে বাণিজ্য শাখায়  গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। মেয়েকেও বলেকয়ে প্রায় জোর  করেই অঙ্ক নিইয়েছেন।  নিজে তিনি  অঙ্ক অত্যন্ত ভালবাসতেন, এখনও সেই ভালবাসা রয়ে গেছে। ডাক্তারিতে ভর্তি হবার আগে বিএসসি পাশ করেছেন অঙ্কে অত্যন্ত ভাল নম্বর নিয়ে। কিন্তু ছেলে মেয়ে দুজনেরই অঙ্কে কি যে ভয়! অথচ যোগেশের ছেলেগুলোকে দেখো, ভানুর তো কথাই নেই, বাকী দুজনও অঙ্কে যথেষ্ট ভাল। মনে মনে অল্প একটু  অপরাধবোধ হয়,  এদের ছোটবেলায় আরো সময় দিলে, এদের নিয়ে রোজ বসলে হয়ত এত অঙ্কভীতি হত না দুজনের।  তিনি বসতেন শুধু ছুটির দিন আর না পারলেই  বকা, ছেলেকে তো মেরেওছেন প্রচুর।
.
পারুর অঙ্ক শেষ হতে হতেই অমর এসে যায়, খবর দেয় সবাই ভাল আছে ওরা। এর মধ্যে গতকালই  দেশ থেকে কাকার চিঠিও পেয়েছে একজনের হাতে। রমেশ ও উমেশের জন্যও দুটি আলাদা চিঠি ছিল, অমর নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে।  যোগেশরা  ভালই ছিলেন, অন্তত  চিঠি লেখার সময় পর্যন্ত। চিঠির তারিখ অবশ্য সেপ্টেম্বরের। তাতে ছোটছেলের  অন্নপ্রাশনে  সম্ভব হলে যেতে বলেছিলেন যোগেশ,  অনুষ্ঠান  নভেম্বরে মানে এই মাসেই।  আর কয়েকদিনের মধ্যেই। চিঠি  আসতে  এত সময় লেগেছে যে কাল পরশুর মধ্যেই বেরিয়ে না গেলে সময়ে  পৌঁছানো যাবে না।  রমেশ একটু চিন্তায় পড়ে যান, এখন পূর্ব পাকিস্তান যাওয়া মানেই বিপদের আশঙ্কা পদে পদে। অমলা বা পারুকে সঙ্গে নেবার প্রশ্নই নেই, অমরকেও না নেওয়াই উচিৎ। তাঁর যদি কিছু হয়েই যায় পথে তবে অন্তত বাকীরা  বেঁচে থাকবে। কিন্তু তাঁরও কি যাওয়াটা উচিৎ? আর উচিৎ হলেও আদৌ সম্ভব হবে কি? অথচ যোগেশ একা ঐ দেশে ছোট্ট  শিশুটার মুখে প্রথম ভাত তুলে দেবে আর বংশের মধ্যে সবার বয়োজ্যষ্ঠ তিনি, তাঁরই তো এই অনুষ্ঠান করার কথা --- আর  তিনিই দূরদেশে চুপচাপ বসে থাকবেন।  অমলা বোঝেন রমেশের মনে দ্বন্দ্ব চলছে, বলেন ঐ দূর বিদেশে মেজ ঠাকুরপো  একলা একলা কি যে করছে! রমেশ কেমন চমকে ওঠেন বিদেশ!? কোনটা বিদেশ আর কোনটাই বা  স্বদেশ তাঁদের আজ?  ময়মনসিংহ  তাঁদের উর্দ্ধতন তিন কি চার পুরুষের  জন্মভূমি, তাঁদের ও।   পৈত্রিক উত্তরাধিকার যা কিছু,  সবই ময়মনসিংহে, যা আজ বিদেশ হয়ত বা শত্রুদেশও। আর এই কলকাতা শহর, এখানে তো বাসাবাড়ি। এসেছিলেন পড়াশোনা করতে। সেসব শেষের পর চাকরি পেয়ে গেলেন এই দমদমায়, তখনো ভাবতেন অবসরের পর ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বিয়ে  সব কর্তব্য সমাপ্ত হলে ফিরে যাবেন আবার দেশের বাড়িতে,  শেষজীবনটা  জঙ্গলবাড়িতে  নিজেদের খেতখামারেই কাটিয়ে দেবেন এরকমই পরিকল্পনা ছিল তাঁর।  এই বাসাবাড়ি, এই কলকাতা শহরই  এখন তাঁর নিজের ভূমি, নিজের দেশ। যোগেশ যে মনে করে ঐ কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহই তার দেশ, সে একেবারে ছেড়ে আসা যায় না  সে তো খুব ভুল কিছু নয়, রমেশ বারেবারে বলেছেন ওদের চলে আসতে নিরাপত্তার কারণেই।  মনে মনে কিন্তু জানেন ওখানে থাকলে তিনিও সম্ভবতঃ একই কাজ করতেন।

স্থান কলকাতা   কাল ১৯৪৯ সাল ডিসেম্বর মাস

-
শনিবার কলেজে তেমন ক্লাস থাকে না, আর শীতের ছুটি পড়ার সময়ও হয়ে এসেছে, ভানু তাই আজ আর কলেজ যায় নি। সুহাস এসে যাবে বেলা দুটোর মধ্যেই, তারপরই  দুই ভাইয়ে বেরিয়ে হ্যারিসন রোড, বড়বাজারের দিকটায় যাবে প্রথমে।  দাদার জন্য একটা ভাল দেখে আলোয়ান কিনতে হবে, ঠান্ডাটা এবারে জব্বর পড়েছে আর দাদার আলোয়ান সেই কবেকার। কিশোরগঞ্জে থাকতে বাবা কিনে দিয়েছিল, সেই নিয়েই কলকাতা আসে, আর কেনে নি নতুন। কেমন পাতলা জ্যালজ্যালে  হয়ে গেছে, হাতে নিলে পেঁজা পেঁজামত দেখা যায়।  সুহাসও দেশের আলোয়ানই সাথে এনেছিল, পরে যখন ভানু এল, সেবার শীতে বাবা এসে দুইভাইকে নতুন আলোয়ান কিনে দিয়ে গেল। প্রভাসকেও বলেছিল, কিন্তু সে অস্বীকার করে জানায় প্রয়োজনমত পরে কিনে নেবে। বাবাও আর তেমন জোর  করেন নি, তারপর বছর দুই কেটে  গেলেও দাদা আর  নিজেও কেনে নি, বাবাও আর এর মধ্যে এদিকে আসতে পারেন নি।  দাদাকে বলছে দুইভাই কবে থেকে, কিন্তু সে কেবলই হ কিনতাম কিনতাম করে দিন কাটিয়ে চলেছে আর এদিকে ঠান্ডায় বুকে কফ বসে গেছে, সারারাত কাশে।  আজ দুভাই ঠিক করেছে  নিজেরাই গিয়ে গরম দেখে ভাল একটা আলোয়ান একেবারে কিনেই নেবে। আজ তিনভাইয়ের  জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি যাবার কথা, কদিন কাটিয়ে ফিরবে, ছাত্রছাত্রীদেরও বার্ষিক পরীক্ষার পর  ছুটি সব, সেই জানুয়ারীতে নতুন ক্লাস শুরু হবার পর আবার পড়াতে যাওয়া।  কোনকারণে পরীক্ষার ফল যদি অভিভাবকদের আশানুরূপ না হয়, তাহলে ছাড়িয়ে দেবার সম্ভাবনাও আছে। তবে সেসব পরে ভাবা যাবে, এখন কদিন  সেই সকাল থেকে উঠে দৌড়াতে হবে না সেই শান্তি।  সকালেই কথা হয়ে গেছে, দুইভাই মেস থেকে চলে যাবে আর প্রভাস এই বছরের শেষ টিউশানিটা সেরে   একটু রাত করে সোজা দমদমে যাবে।  হ্যারিসন রোডের ওপরেই  মস্তবড় দোকান  শাল মিউজিয়াম, বাইরে থেকে দেখে একটু  ভয় ভয় লাগলেও নিজেদের মধ্যে একটু শলা পরামর্শ করে দুভাই ঢুকেই পড়ে। গাঢ় বাদামী রঙে চারকোণে কালো কলকা তোলা একটা শাল পছন্দ হয়,  কর্মচারী দাম বলে পঞ্চাশ টাকা। এত দাম ওরা ঠিক আশা করে নি, দুজনে মিলে কুড়ি টাকা দিলে ওদের হাতে কিছু টাকা বাঁচে। পঞ্চাশ টাকা তো ওদের কাছে নেইও। এখন উপায়?

ভানু আস্তে করে বলে ল মেজদা যাইগা অহনসুহাস বলে খাড়অ কুড়ি পঁসিশ টাকায় কিছু আছে নাকি জিগাইয়া লইবলে ঘুরে  তাকিয়েই দেখে  কর্মচারীটি মুখে কেমন একটা হাসি পাশে আর এক খরিদ্দারের সাথে ইশারায় কী যেন বলছে। একটু অবাক হয়ে সুহাস ভানুর হাতে টান দিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে  খরিদ্দার ভদ্রলোকটি বেশ শৌখিনগোছের সাজপোষাক, পরণে ধাক্কাপেড়ে মিহি ফরাসডাঙ্গার ধুতি, কোঁচাটি কুঁচিয়ে হাতে  আলগোছে ধরা, ফিনফিনে পাতলা আদ্দির পাঞ্জাবী গিলে করা, তার উপরে দেখেই বোঝা যায় দামী শাল, হাতে একটি বেতের বাহারি ছড়ি, মুখে বিদ্রুপের হাসিসুহাসের মাথাটা চড়াৎ করে গরম হয়ে যায়, প্রায় খিঁচিয়ে জিগ্যেস করে কিছু বলবেন? শৌখিনবাবুর মুখের হাসি আরেকটু সরু হয়ে আসে, ঠোঁটের একপাশ দিয়ে হেসে বলেন না না,  তা ভায়া বুঝি কলকেতায় এই এলেন? কোতায় ছিল জমিদারি?  প্রচন্ড রাগ ও ক্ষোভের তাৎক্ষণিক ধাক্কায় সুহাসের মুখে প্রথমে কথা যোগায় না, কপালের একপাশে একটা রগ ফুলে উঠে দপদপ করে হাত মুঠি পাকিয়ে যায়। ভানু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে মেজদাকে একটু টেনে নিয়ে বেশ জোরে জোরে বলে আমরা সিটি কলেজে পড়ি, কাছেই থাকি বলে একটা অনির্দিষ্ট দিকে হাত দেখায়। বাবু একটু দমে গেলেও একেবারে থামেন না, একটু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতেই বলেন অ তা বেশ। তা  দিব্বি তো বাঙলা বলেন দেকচি, এতক্ষণ কিচির মিচির করচিলেন কেন? কী বললেন? সুহাসের গলা দিয়ে একটা ছোট গর্জন বেরিয়ে আসে। সে আওয়াজে দোকানের বাকী লোক ফিরে তাকায় আর হন্তদন্ত হয়ে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি সুহাস আর ভানুর হাত ধরে বলেন আসুন আসুন আপনারা এদিকে আসুন আমি দেখাচ্ছি আপনাদের, যা চান আপনারা। এঁর পোষাকও মোটামুটি দামী, শুধু ধুতিটি মালকোঁচা মেরে পরা। ভানু বোঝে  ইনি হয় দোকানের মালিক  নয় ম্যানেজার গোছের কেউ, কারণ কর্মচারীদের মধ্যে তটস্থ ভাব। সুহাস এখনও গুম হয়ে আছে, ভানুই পছন্দের শালটি দেখিয়ে জানায় মোটামুটি গোটা কুড়ি টাকার মধ্যে যদি এরকম গরম একটি আলোয়ান উনি দিতে পারেন, কলকা বা কোনরকম কাজের দরকার নেই,  তাহলে ভাল হয়।  ভদ্রলোক  শালটি নিয়ে উলটে কি যেন দ্যাখেন তারপর বলেন আর পাঁচটা টাকা বেশী দিতে পারবেন? তাহলে এটাই নিয়ে যানদুই ভাইই খুব অবাক হয়ে যায় --- অর্ধেকদামে উনি দিতে চাইছেন? নাকি বড় বড় দোকানে এমনিই বাড়িয়ে রাখে দাম? কিন্তু তাহলে হঠাৎ ওদের জন্য কম করছেন কেন? ভদ্রলোক ওদের বিস্ময় দেখে আস্তে আস্তে বলেন এই দোকানে এসে অপমান্যি হয়ে দুঃখু পেয়ে আপনারা চলে গেলে দোকানের অকল্যাণ হবে, বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, টেরও পাব না। আমার মায়ের বারণ আছে যে।

-
প্রভাস যখন জ্যাঠার বাড়ি পৌঁছাল ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, সবাই অপেক্ষা করছে প্রভাস গেলেই খেতে বসবে একসাথে। খাবার ঘরে পারু আগেই কাঠের পিঁড়ি পেতে জায়গা করে রেখেছিল, চার  ভাইকে নিয়ে খেতে  বসেন রমেশ। পারু মায়ের সাথে পরিবেশনে লাগে, পরে মায়ের সাথেই খাবে। খেতে বসে অমরেশের সাথে প্রভাসের খুব তর্ক বেধে যায়। এই বছর ঈস্ট বেঙ্গল লিগ, আইএফএ শীল্ড আর রোভার্স কাপ তিনটেই  জিতেছে, এই প্রথম কোন ভারতীয় ক্লাব একই বছরে তিন তিনটে খেতাব জিতে নিল। ফলে প্রভাসের মনে খুব আনন্দ। অমর মোহনবাগানের সমর্থক, সে খোঁচা দিয়ে বলে হ্যাঃ স্যুইডিশদের কাছে ত হাইর‍্যা ভুত হইছিস, আর গতবছরও তো  তোরা শীল্ডে একগোলে হারছস, তার আগের বছরও হারছস প্রভাস উত্তেজিত হয়ে বলে মিছা কথা কইস না বড়দা, তার আগের বছর শীল্ড হয়ই নাই। আর এইবারে তরা দুই গোল খাইছস, হ্যার ব্যালা? ভানু পাশ থেকে ফুট কাটে ঈস্টব্যাঙল এইবার রোভার্স কাপেও জিতসে, ঈস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েজরে ১ গোলে হারাইসে, সেই খবর রাখো?  সুহাসের খেলাধুলায় খুব একটা উৎসাহ নেই, সামান্য যেটুকু যা খবর রাখে সে ক্রিকেটের, ফুটবল তার একেবারেই ভাল লাগে না। সে চুপচাপ খেয়ে যায়রমেশ নিজে যদিও ফুটবলে উৎসাহী তবে তেমন জোরালো সমর্থন কোনও  দলকেই করেন না, ঈস্টবেঙ্গলের দিকে হালকা একটু টান আছে এই পর্যন্ত। ছেলে আর ভাইপোর তর্কের মধ্যে তাই তেমন অংশগ্রহণ করেন না, শুধু মাঝে মাঝে আপ্পারাও, আমেদ খানদের  নিয়ে টুকটাক মন্তব্য করেন। খাওয়া শেষ করে বৈঠকখানায় এসে সবাই বসলে সুহাস শালখানা বের করে দাদার হাতে দেয়, বলে এখন থেইক্যা এইটা গাও দিস, ঐ জাউল্যা গামসাটা ফালাইয়া দে এইবার।  বাকীদের আগেই দেখানো হয়ে গেছে, ওরা পারুর জন্যও একটি নানারকম রঙ মেলানো পশমের চাদর এনেছে, সে মেয়েও খুব খুশী, সেও দেখায়  দাদাকে এবার।  কিন্তু প্রভাস যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না এমন নরম গরম সুন্দর দেখতে শালটা তার জন্য এনেছে ভাই।  বলে অ্যার তো অনেক দাম হইব, এতডি দাম দিয়া  ক্যার লাইগ্যা আনছস? ভানু এইবারে ওদের দুভায়ের সংকল্প আর দোকানের ঘটনা বলে--- শুনতে শুনতে রমেশ প্রথমে  খাড়া হয়ে বসেন, পরে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি করতে থাকেন। মুখের বুলি  নিয়ে এই হ্যানস্থার অনেক ঘটনাই তাঁর কানে এসেছে, অনেকটা এইজন্যই তাঁর ছেলেমেয়ে দুজনই বেশীরভাগ সময় কলকাতার চলিত বুলি বলে। ভাইপোরাও অন্যদের সাথে তাইই বলে, কিন্তু এখানে তো ওদের নিজেদের মধ্যে কথাই কাল হয়ে উঠেছিল প্রায়। ভাগ্যিস দোকানে  শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কর্তাস্থানীয় লোকও ছিল।

পরের দিনটি ছুটির দিন, বাকীরা তো বটেই আজ রমেশও খানিক ঢিলেঢালাউমেশরা এসে যাবে সকালেই, সেরকমই জানিয়েছে। অমলা বলে রেখেছেন ছোটজাকে সঙ্গে নিয়ে একবারটি দক্ষিণেশ্বরে মাকে দর্শন করে আসবেন। রমেশ অবশ্য বলেছিলেন কাল সবাই মিলে আদ্যাপীঠ থেকে ঘুরে আসবেন, তা অমলা আজই যেতে চান, তাঁর মন টেনেছে। মুখটুখ ধুয়ে বৈঠকখানায় এসে দৈনিক অমৃতবাজার খুলে দ্যাখেন অ্যাবডাকটেড উয়োম্যান রিকভারি বিল পাস হয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প খোলা হয়েছে তার খবর,  খবরের নীচের দিকে  একলাইন লেখা ক্যাম্পের পরিচালক/চালিকাবর্গের  মধ্যে সামান্য কিছু মতদ্বৈধ দেখা দিয়েছে। এই ব্যপারটা রমেশ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন নি। আরে যাদের যেখানে ঠাঁই হয়েছে তাদের সেখান থেকে আবার টেনে এনে কি লাভ! আর ওইসব মেয়েদের কি বাড়ি এনে সমাজ সংসার কারো কিছু লাভ হবে? যুক্তি কি? না সীতামাঈয়াকেও তো উদ্ধার করে আনা হয়েছিল --- অসীম বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে ফেলেও হঠাৎ থেমে যান।  যুঁই, মেজবৌ ওরা কেমন আছে? আজ যদি --- যদি --- আর ভাবতে পারেন না, বুকটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। একটু ধাতস্থ হতে না হতেই প্রভাস ঘরে ঢোকে কিছু ব্যস্ত হয়ে জ্যাডা আফনেরে ডাকে নীচে, জেইল সুপারে বইল্যা পাডাইসে, অক্ষণি হাসপাতাল যাওনের কইতেসে। বেশ অবাক হয়েই নীচে এসে বৃত্তান্ত শুনলেন, কাল নাকি রাত দুটোর  দিকে পুলিশ বেলগাছিয়ার দিক থেকে একটা মেয়েলোক  গ্রেপ্তার করে এনেছিল, অত  রাতে  লকাপে না ঢুকিয়ে হাসপাতালে এনে  হাতকড়া লাগিয়ে একটি ঘরে বন্ধ করে  রেখে যায়। আজ সকালে দেখা যাচ্ছে হাতকড়া মাথায় ঠুকে মাথা ফাটিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে। রমেশ বোঝেন এখন কিছু হয়ে গেলে সবাইকে নিয়ে টানাটানি পড়বে তাই সুপার জলদি তলব  করেছেন।  জলখাবারটাও খাওয়া হয় নি, কিন্তু  দেরী করা যাবে না বিধায় দ্রুত তৈরী হয়ে  বেরিয়ে যান। অমলা তাড়াতাড়ি কিছু লুচি আর আলু ফুলকপিভাজা একটা টিফিন বাক্সে ভরে দেন সঙ্গে।  অমন অনেক ছুটির দিনেই রমেশকে সব ফেলে দৌড়াতে হয়েছে, অমলার তাই অভ্যাস আছে সকালে রান্নাঘারে ঢুকেই শুকনো কিছু খাবার ঝটপট তৈরী করে রাখা।

হাসপাতালে পৌঁছে রমেশ দ্যাখেন  সুপারসায়েব চিন্তিতমুখে পায়চারি করছেন, পাশে কম্পাউন্ডার শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে। ভেতরে গিয়ে দেখলেন কম্পাউন্ডার আনাড়িহাতে কিছু গজতুলো চেপে দিয়েছে মাথায় আর সেসব ভিজিয়ে কালচে লাল রক্তের ধারা চুঁইয়ে আসছে, রক্তে  গলা ও বুকের কাপড় ভেজা দেখে বুঝলেন মাথা ফাটাবার পরেও বসে ছিল মেয়ে, নাহলে বুকের কাছে অতটা চ্যাটচ্যাটে রক্ত লেগে থাকার কথা না। সংজ্ঞা নেই মেয়েটির, শুনলেন জলের ঝাপটা আর স্মেলিং সল্ট  দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর একটা চেষ্টা করেছিল বটে লাভ হয়নি কিছু। প্রথমে হাতকড়াটা খোলালেন,  দ্রুতহাতে ক্ষত পরিস্কার করে সেলাই দিতে গিয়েই বোঝেন মাথাটা ফাটার পরেও লোহার হাতকড়া দিয়ে আঘাত করে গেছে বারবার এহ বিষিয়ে না যায়! কিম্বা গেছেই হয়ত বিষিয়ে এতক্ষণে, গায়ে তো হাত দেওয়া যাচ্ছে না, এত তাপ। সেলাই করার সময় একটু নড়ল বটে কিন্তু চেতনা ফেরার কোন লক্ষণ নেই। ভাল করে পরীক্ষা করার জন্য  বুকে স্টেথো বসাতেই হঠাৎ মেয়েটি সজোরে পা ছুঁড়ল।  সাহায্যকারী কম্পাউন্ডারবাবুর পেটে গিয়ে লাগায় উনি প্রায় উলটে পড়েই যাচ্ছিলেন। ভীষণ রেগে কম্পাউন্ডারবাবু আর্দালিকে ডেকে হাত ও পা দুইই বেডের সাথে বেঁধে দিতে বললেন।  রমেশের কেমন খটকা লাগল --- মেয়েটির কি শুধু কপালেই  আঘাত নাকি আরো কোথাও ক্ষত আছে? পরীক্ষা করা দরকার ভালভাবে।  হাসপাতালে কোন বন্দী ভর্তি না থাকায় কাল রাতে দুজন নার্সই বাড়ি চলে গিয়েছিলেন, নাহলে রাতে একজন থাকেনএতক্ষণে  একজন এসে গেছেন। তাকে ডেকে  সাবধানে কাপড়টা সরাতে বললেন আর  কম্পাউন্ডারকে বললেন ওইসব বাঁধাবাধি আপাতত থামিয়ে হাত আর পা চেপে ধরে রাখতে নার্সটি সাবধানে  উর্ধাঙ্গ থেকে কাপড়খানি সরিয়ে দিলেন, এবারে আর হাত পা কিছু ছুঁড়ল না মেয়েটিব্লাউজটিতে কোন বোতাম নেই, একটি সেফটিপিন মাঝখানে আটকানো, তাতেই যেটুকু আব্রু রক্ষা হয়--- এবং অনাবৃত অংশের দিকে তাকিয়ে উপস্থিত সকলেরই শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল। নার্স আবার কাপড় দিয়ে ঢাকা দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু  চিকিৎসকের কর্তব্যে রমেশ দ্রুতহাতে সেফটিপিনটিও খুলে স্তনদুটি সম্পূর্ণ উমুক্ত করে  টিংচার আয়োডিনমাখা তুলোর দিকে হাত বাড়ানোর মুহূর্তেই সুপার ঢুকলেন ঘরে আর ওহ মাই গড! বলে স্থানু হয়ে গেলেন। মেয়েটির দুটি স্তনে অজস্র দাঁতের পাটির দাগ। কেউ  যেন রবারের বল ভেবে অনবরত কামড়ে গেছে লাল, কালচে লাল,  গভীর, হালকা বিভিন্ন রকমের অন্তত ৫২টি  ক্ষত। গভীর দাগগুলির ভেতরের দিকে কালচে সাদা পুঁজের মত কিছু জমা হয়েছে।  সোনার পুতুল ভাইঝিটির মুখ মনে পড়ে গলা শুকিয়ে বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে রমেশের। এ মেয়েকে কি বর্ডার পেরোনোর আগেই --- নাকি বর্ডারে --- আহারে বাছা আর একটু হলেই তো তুই পৌঁছে যেতিস নিরাপত্তায়।  ঠিক তখনই মেয়েটি টিংচার আয়োডিনের স্পর্শে একবার আমূল কেঁপে উঠে অস্ফুটে বলে ওঠে অ্যায় খোদা!  লাথি না খেয়েও ছিটকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন রমেশ।  না মেলা   অঙ্কের সামনে অবাক হয়ে মুখোমুখী দাঁড়িয়ে থাকেন জেলসুপার আর জেলের ডাক্তার

টীকা
আলোয়ান পাড়হীন একরঙা পশম বস্ত্র।
শাল পাড় ও দুইপ্রান্তে নকশা করা পশম বস্ত্র

১৯/১২/১৯৪৯ অ্যাবডাকটেড পার্সনস (রিকভারি এন্ড রেস্টোরেশান) বিল পাস হয়।  

No comments:

Post a Comment