খোঁজাখুঁজি

Wednesday, November 29, 2017

সিজনস অব বিট্রেয়াল – পঞ্চম পর্ব

প্রথম পর্ব   দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব   চতুর্থ পর্ব  

পঞ্চম পর্ব   ষষ্ঠ পর্ব   সপ্তম পর্ব     অষ্টম পর্ব

নবম পর্ব 

সিজন-১ (কন্টিন্যুড)


স্থান কলকাতা শহর   কাল ১৯৪৮ সাল ডিসেম্বর মাস

-
মির্জাপুর স্ট্রীটের এই মেসবাড়িটায় ম্যানেজারবাবু দুখী চাকরের সাথে বাজারের হিসেব নিয়ে মহা গোলযোগ বাধিয়ে তুলেছেন; সে বেচারা যতই হিসেব দাখিল করুক তাঁর সন্দেহ কিছুতেই যায় না যে এ ব্যাটা নির্ঘাৎ অন্তত আস্ত দুটো  টাকা সরিয়ে রেখেছে, নাহলে এই কটা নয়া পয়সা ফেরে বাজার থেকে? তিনি গুণে গুণে সাত সাতটা  টাকা দিয়েছিলেন। দুখীও সমানতালে চেঁচাতে শুরু করেছে,  দোকান তো তার পিতা পিতৃব্যগণের নয় যে প্রচলিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দিয়েই যাবতীয় মাছ মাংস, তরকারি, মশলা সে আনতে পারবে, কাল থেকে যেন ম্যানেজারবাবু নিজেই যান বাজার করতে সে আর পারবে না যেতে এই তার সাফ কথা। এত গোলমালে মেসের বাসিন্দারা সবাই গুটি গুটি উঠোন কলতলায় জড়ো হতে শুরু করেছে ততক্ষণে। এরইমধ্যে ম্যানেজারবাবুর নজরে পড়ে পিছন দিকে সুহাষের লম্বা চেহারাটা, তাড়াতাড়ি ডাকেন দ্যাখো তো বাবা সুহাষ হিসেবটা একটু, ব্যাটা সমানে যা নয় তাই বলচেসুহাষদের তিনভাইয়েরই  মানসাঙ্কে দক্ষতার সুনাম আছে মেসে, কিন্তু এই সাতসকালে সুহাষের এইসব ঝামেলায় ঢোকার ইচ্ছে নেই, মনটনও খারাপ, কিশোরগঞ্জের বাড়ির খবর পায় না ওরা বেশ কিছুদিন হল। আজ ছুটি আছে ভেবেছিল বড় জ্যাঠামশাইয়ের কাছে দমদমে যাবে একবার, স্নান সেরেই বেরিয়ে যাবে তিনভাইয়ে। সুহাষ কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে গলা তুলে ডাকে ভান্যুয়া ওই ভান্যুয়া মেসোমশাইয়ের হিসাবটা দেইখ্য্যা দে ছে একবার।  তিনতলার বারান্দায় ভানুর ঝাঁকড়া চুলে ভরা মাথাটা দেখা যায়। ম্যানেজারবাবু খানিক বিরক্ত গলায় বলেন থাক থাক আর লাগবে না, তারপর যত্ত বাঙাল জুটেছে বলে  নীচুগলায় গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকে যান। তিনি বহুদিন এদের বলেছেন তাঁকে দাদা বলে ডাকতে আর এই বজ্জাত বাঙাল ছেলেগুলো সেই মেসোমশাই বলেই ডাকবে, দেখাদেখি বাকী বোর্ডাররাও তাই বলে। এমন কিইবা বয়স হয়েছে তাঁর?  শুধু মাথার চুলটাই যা পড়ে গেছে! আশ্চর্য্য!  ঘরে গিয়েও গজগজ চলতেই থাকে। ছাড়া পেয়ে দুখী একবার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সুহাষের দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরের   দিকে চলে যায়, ও এখন উড়ে ঠাকুরকে  একটু হাতেহাতে সাহায্য করে দিয়ে ধোয়াপাকলার কাজে নামবে।
 
তিনতলায় নিজেদের ঘরে এসে সুহাষ দেখল দাদা স্নানটান সেরে তৈরী। ঠাকুর এর মধ্যে চা আর সকালের বরাদ্দ দুটো করে লেড়ো বিস্কুট দিয়ে গেছে। দাদা আর ভানু তাই খাচ্ছে আর কী নিয়ে যেন খুব হাসছে। সুহাষ আবার হাঁউমাউ গরম না হলে চা খেতে পারে না, ওর জন্য তাই একটা থার্মোফ্লাস্ক কেনা আছে, ওতেই ঢেলে দিয়ে যায় ঠাকুর।  বারোঘরের মেসে কুড়ি একুশজন লোক থাকে, সকলের জন্য দুবার তিনবার চা গরম করা সম্ভব নয় এ আগেই জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই যে যার নিজের ব্যবস্থা করে নেয় যার যার সুবিধেমত। সুহাষ চা ঢেলে  নিয়ে বসতে না বসতেই পাশের ঘরের গোবিন্দগোপাল আর অসীমবাবু এসে ঢোকেন, গোবিন্দবাবুর হাতে আজকের অমৃতবাজার পত্রিকাটা।  ভানু তাড়াতাড়ি নিজের কাপটা তুলে বাইরে রেখে এসে কাচা ধুতি শার্ট বের করে নিয়ে স্নানে যায়। ছুটির দিন এইবেলা কলঘর খালিই থাকবে, বেলা করলে খালি পাওয়া মুশকিল। অসীমবাবু জিগ্যেস করেন কিসু খবর পাইলা নি বাড়ি থাইকা? প্রভাস মাথা নাড়ে, নাহ। বলে আজ দেখি বড়জ্যাডামশইয়ের ওইহানে  যাই --- উনি আছেন মাথার উপরে।  গোবিন্দ ব্জিগ্যেস করেন তোমাদের তো একটা বোনও আছে না দেশে? ঐটাই বেশী চিন্তার বুঝলে? পুর্ব পাকিস্তানে এখন যা অবস্থা  --- তোমার বাবা চলে আসলেই ভাল করতেন।  ঠিক এই ভয় ওরাও পাচ্ছে, কিন্তু  মুখে কেউই তা উচ্চারণ করছে না।   প্রভাস সভয়ে মেজভাইয়ের দিকে তাকায়,  সুহাষ ভীষণ রগচটা। নিজেদের ভয়ের প্রতিধ্বনি অন্যের মুখে শুনে এক্ষুণি না খ্যাঁক করে ওঠে।  কিন্তু তার আগেই গোবিন্দবাবু প্রসঙ্গ বদলে বলেন দ্যাখো জিন্না ব্যাটা মরার পর এখন নাকি মোসলারা ধরে নিয়ে যাওয়া মেয়েগুলোকে নেহেরু ফিরিয়ে আনবে। পাকিস্তান রাজী হয়েছে সব চুক্তিফুক্তি হচ্ছে। আরে ও মেয়েগুলোকে কে ঘরে নেবে বলদিকি? ওরা তো মোসলাই হয়ে গেছে, এতদিন ঘর করেছে --- ধর সেই গতবচ্ছর থেকেই তো পাঞ্জাব লাহোরে লুটপাট  চালিয়েছে। দ্যাখো গে ওদের ঘরে অ্যাদ্দিনে আন্ডাবাচ্ছা পেড়ে টেড়ে রেখেছে। ইতিমধ্যে আড্ডার গন্ধ পেয়ে দোতলার বিমল আর ননীও এসে জুটেছিল। ননী তড়বড়িয়ে বলে, শুধু পাকিস্তান থেকেই তো আনবে না, এদেশ থেকেও ফেরত যাবে, হিন্দুরা যে মেয়েদের লুটে রেখে দিয়েছিল তারাও সব এবার ফেরত যাবে। গোবিন্দবাবু  মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলেন থামো  দিকিনি, হিন্দুরা আর কটা মেয়েকে রেখেছে শুনি? দ্যাখগে যাও হিন্দুদেরই   ঘর কে ঘর লুটে রেখেছে। ওরা কি কম হিংস্র নাকি? এদিকে তো গডসেকে ফাঁসি দিয়ে দিল, তা বাপু গান্ধী গান্ধী কর এই এত লোক মরল এত লোকের ঘর পুড়ে গেল কই গান্ধী তো তখন অনশনে বসল না? হ্যাঁ একেবারে প্রাণে মেরে দিয়ে ঠিক করেনি মানছি, কিন্তু এগুলোও তো দেখবে বিমল এই সুযোগে খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে বলে গুজরাটে বম্বেতে  এখনও কাটাকাটি চলছে। অসীমবাবু মুখ বিকৃত করে বলেন হ্যারায় যেইহানো থাকব  কাটাকাটি চলবই। নেহেরু যে কি করতেসে? ননী বলে তা একটা মানুষ কতদিকে দেখবেন? কাশ্মীরেও তো ব্যাটারা সমানে খাবলাচ্ছে। এর মধ্যেই  একতলা থেকে ঠাকুরের হাঁক শোনা যায় খাবার ঘরে বাবুদের জলখাবার দেওয়া হয়েছে।         



-
বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ তিনভাই রমেশচন্দ্রের  দমদমের বাড়ি পৌঁছে দ্যাখে বড়জ্যাঠা সেদিন বাড়িতেই আছেন, পেশায় তিনি  দমদমা সেন্ট্রাল জেলের সরকার নিযুক্ত চিকিৎসক। বড়দাও বাড়িতে।  ওদের দেখে রমেশ  জিগ্যেস করেন খবর দেবার লোকটি এত সকাল সকাল পৌঁছে গ্যাছে? কীসের খবর? ওদের মুখ শুকিয়ে যেতে দেখে রমেশ তাড়াতাড়ি আশ্বস্ত  করেন; না না কোন খারাপ খবর টবর নেই। এমনিই আজ ছুটি তাই ওরা আসলে একটু গল্প সল্প করতেন বলে খবর পাঠিয়েছিলেন একটা লোককে দিয়ে, তা সে ওরা নিজেরাই এসে পড়েছে, একেই বলে রক্তের টান। বলে বেশ জোরে জোরে হাসেন। প্রভাস আর সুহাষও হাসে, ভানু হাসিমুখে  চুপ করে লক্ষ করে জ্যাঠাকে,  কিছু একটা চিন্তা ঘুরছে জ্যাঠামশাইয়ের মাথায়, চোখজোড়া ঠিক যেন ওদের দেখছে না। প্রাথমিক কুশলসংবাদ আদানপ্রদানের পর ভানু জিগ্যেস করেই ফেলে কিশোরগঞ্জের কোন সংবাদ উনি পেয়েছেন কিনা; হ্যাঁ পেয়েছেন, ঘাড় নেড়ে জানান রমেশ,  হাল্কা  ছায়া  কি সরে গেল মুখের উপর দিয়ে ঠিক বুঝতে পারে না। রমেশ জানান যোগেশের পত্র এসেছে,  ওঁরা দুজন যুঁইকে নিয়ে ভাল আছেন জানিয়েছেন।  ভানুরা জানে ওদের আর একটি ভাই কিংবা বোন আসতে চলেছে আগামী দুই তিন মাসের মধ্যেই সেও এক কারণ বাবার এই সময় দেশ থেকে না আসতে চাওয়ার। বাবা মা বোন ভাল আছে শুনে আশ্বস্ত হয় ওরা।  দুপুরের খাওয়াদাওয়াও ভালই হয়, জ্যাঠামশাইয়ের অবস্থা ভাল। তিনভাই যদিও টিউশানি করে বেশ কটি, মেসে অর্থের যোগান দিতে সমস্যা হয় নি এখনও, তবে ম্যানেজারবাবুর ভাষ্যে বাজার এমনি আগুন যে তিনি বলেই সবকটি বাসিন্দাকে  গুছিয়ে তিনবেলা দুটি ডালভাত মাছভাত  খেতে দিতে পারছেন, অন্য কেউ হলেই পারত না।  তা সে ডাল আর মাছের ঝোলের মধ্যে খুব কিছু তফাৎ করা যায় না দুইই কর্পোরেশানের জলের মতই প্রায়। জ্যাঠার বাড়ীর পালং শাকের ঘন্ট,  কড়াইশুঁটি ছড়ানো  ঘন সোনামুগের ডাল,  শীতের বেগুনের ফালি বেগুনভাজা, কাতলা পেটির কালিয়া, পাঁঠার মাংস আর শেষপাতে একবাটি করে ঘন ক্ষীরের মত দুধ খেয়ে বড়দা আর পারুর সাথে প্রভাস আর ভানু বসল ক্যারম খেলতে। বাড়ির রান্নার স্বাদ পেয়ে  সুহাষের চোখজোড়া একটু লেগে এসেছে, বৈঠকখানার তক্তপোশেই একটু গড়িয়ে নিতে গেল সে।


অঘ্রান পৌষের বেলা ঝপ করেই আঁধার নেমে আসে, দিনকালও তেমন ভাল নয়।  কলুটোলা মেছুয়াবাজারের দিকে খুচরো গন্ডগোলের খবর কানে আসে। জেলের ডাক্তার হওয়ার সুবাদে  এমন অনেক রোগী রমেশকে নিত্যই দেখতে হয়, কেস  হিস্ট্রি লিখতে হয়  যে তার থেকেও তিনি এলাকার, শহরের, দেশের হালচাল ভালই খবর রাখেন তবে সরকারী চাকরি তাঁর আর এমনিতেও অহেতুক চর্চার অভ্যাস নেই তাই সেসব কথা খুব একটা কাউকে বলেন না। যোগেশ যদি এখানে থাকত তাহলে হয়ত দুচারকথা আলাপ করতেন।   প্রভাসদের তাই আজ রাতটা থেকে কাল সকালে যেতে বলেছেন।  যে লোকটিকে দিয়ে ওদের মেসে খবর পাঠিয়েছিলেন, তাকেও সেরকমই বলা ছিল, কাজেই  সেখানেও অসুবিধে হবার কথা নয়।  সে হবে না তা ওরা জানে।  ম্যানেজারবাবু এমনি যতই খরচখরচা বেড়ে গেছে বলে চেঁচামেচি করুন না কেন ওমনিতে বেশ সেয়ানা। কেউ সাতটার মধ্যে মেসে না ঢুকলে বা অন্য কাউকে দিয়ে রাতে খাবে খবর না পাঠালে আর তার জন্য রাতের খাবার তৈরীর ব্যবস্থাই করেন না। ওরা তবু একটু কিন্তু কিন্তু করে খবর যখন পাওয়াই গেছে এবার সন্ধ্যে সন্ধ্যে বেরিয়ে  গেলেই হয়।  এইবার রমেশ সংক্ষেপে বলেন দরকারী কথা আছে ওদের সাথেভানুর বুকটা একটু ধ্বক করে উঠল, ও তাহলে ঠিকই বুঝেছিল। অন্ধকার হলে শুখো কাজের মেয়েটি সেদিনের মত সব সেরে  রাতের খাবার নিয়ে চলে গেল। জ্যাঠামশাই সদরদরজা ভাল করে বন্ধ করে দোতলার বড় ঘরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে বসলেন। ঠাকুরঘরে সন্ধ্যে দেখিয়ে  ঠাকুরকে শয়ন দিয়ে জেঠিমাও এসে বসলেন।  গলাখাঁকারি দিয়ে রমেশ বলতে শুরু করলেন; দেশ থেকে যোগেশের চিঠি এসেছে, ওরা ভাল আছে সবই ঠিক, কিন্তু দেশের হাল বেশ গোলমেলে, যে কোনও সময় বড় ঝামেলা শুরু হয়ে যেতে পারে, যোগেশের চিঠিতেই জানা গেছে ভানুদের দিদিমনি, বড়মামা মন্টুমামা আর নান্টুমামাকে নিয়ে শিগগীরই এদেশে চলে আসবার ভাবনা চিন্তা করছেন পারছেন না ওদের মায়ের কথা ভেবে, ওদের ভাই কিম্বা বোন যাই হোক, ভালয় ভালয়  হয়ে গেলেই উনিও রওনা দেবেন।  এমতাবস্থায় রমেশ ভেবেচিন্তে স্থির করেছেন এখন প্রভাসরা দুই ভাই একবার দেশে যাক, গিয়ে মা আর যুঁইকে  মামাবাড়ি বাজিতপুরে রেখে দরকার হলে  কিছুদিন থেকে হালচাল বুঝে আসুক, ওখানে যোগেশ একলা হঠাৎ কোন ঝামেলা শুরু হলে মুশকিল পড়ে যাবেন। সুহাষের এবার আই কম ফাইনাল ওর গিয়ে কাজ নেই, ভানু আর প্রভাস যাক। সুহাষ একটু আপত্তি করে, তারও ইচ্ছা বাড়ি যাবার,  কতদিন দ্যাখে না বাবা মা বোনটাকে --- জ্যাঠামশাই সস্নেহ দৃঢ় কন্ঠে মানা করেন, একসাথে সকলের কলকাতা ছাড়া ঠিক হবে না, এখানে যদি কোনও দরকার লাগে, তাঁর সরকারী চাকরি সামলে তিনি হয়ত সবদিক রক্ষা করতে পারবেন না, নিজপুত্রের উপর খুব ভরসা তাঁর নেই। অগত্যা সুহাষ আর কথা বলে না, মনঃক্ষুন্ন হয়ে চুপ করে বসে থাকে হঠাৎ যেন শীতটা আরো বেশী লাগে শালটা ভাল করে টেনে মুড়িসুড়ি দিয়ে নেয়। কিন্তু রমেশের কথা এখানেও শেষ হয় নি। এইবার তিনি আরো কিছু বলেন। তাঁর এক পুরানো রোগী আকরম আলি, মধ্যমগ্রামে বাড়ি, তিনি মনস্থ করেছেন পূর্ববঙ্গে চলে যাবেন, সম্পত্তি বিনিময়ের জন্য জায়গাজমিসহ উপযুক্ত সম্পত্তি খুঁজছেন। মধ্যমগ্রামে তাঁর ছয়বিঘা বাগানসহ বসতবাড়ি আর টাকির দিকে কিছু ধানিজমি আছে। রমেশ চান আকরম আলি ও তাঁর জ্ঞাতিভাই ভানুদের সঙ্গে যান, যোগেশের সঙ্গে কথাবার্তা বলাকওয়া হোক, তারপর রমেশ তো রইলেনই। যোগেশ রাজী হলে ওঁদের জঙ্গলবাড়ির জমি যা ওঁদের সবচেয়ে ছোট ভাই মনীশ দেখাশোনা করে, সেখানেও আকরম আলিকে নিয়ে গিয়ে দেখানো যাবে। আলিসাহেব মোটামুটি না দেখেই বিনিময় করতে রাজী হয়ে রয়েছেন, রমেশও। কিন্তু সেখানে থাকেন যোগেশ ও মনীশ, তাঁদের মত ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয় এ রমেশ তাঁদের স্পষ্টই জানিয়েছেন।


স্থান কিশোরগঞ্জ   কাল ১৯৪৮ সাল ডিসেম্বর মাস

-
যুঁইয়ের জীবনে আজ একটা বিশেষ দিন আজ প্রথমবার রিকশায় চড়েছে বীথি, নীলি আর যুঁই আজ স্কুল থেকে আসার সময় কিশোরগঞ্জ টেলার্সের সামনে থেকে রিকশায় চড়ে ওরা তিনজন নীরদজ্যেঠুদের বৈঠকখানা পর্যন্ত এসেছে কিশোরগঞ্জে রিকশা চালু হয়েছে বছরখানেকেরও ওপর, কিন্তু ওদের তাতে চড়বার কোনও সুযোগই হয় নি কিশোরগঞ্জের মধ্যে কোথায়ও যেতে গেলে হেঁটেই যায়, বড়জোর বাবার সাইকেলে বসে; তাও আজকাল বড় হয়ে গেছে বলে সাইকেলে চড়লে মা বকে ওকেও, বাবাকেও আর দেশের বাড়ী জঙ্গলবাড়িতে কিম্বা মামার বাড়ী বাজিতপুরে যেতে গেলে সেই নৌকা আর গোরুর গাড়ীই ভরসা ওরা তিনবন্ধু 'সপ্তাহ ধরেই শলা পরামর্শ করছিল, কেমন করে সবার চোখ এড়িয়ে একটু রিকশায় চড়া যায় নীলির খুব সাহস; দিব্বি রিকশাওলাদের কাছে গিয়ে ভাড়াটাড়া জেনে এসেছে যুঁই তো ভয়েই মরে, কেউ যদি দেখে ফেলে মা'কে বা বাবাকে বলে দেয়! বীথিও ভীতু ওদের ভয় দেখে রিকশাওলা একগাল হেসে বলে আইস্যা আফনেরা এক আনা দিয়েন, লন বসেন' কোনওমতে গাদাগাদি করে তিনজনে উঠে বসে সে কী আশ্চর্য্য এক অভিজ্ঞতা --- রাস্তার লোকগুলোকে কেমন ধীরগতি লাগে --- ওরা কেমন মঞ্চের উপরে চড়ে সাঁই সাঁই করে চলে এলো --- বসার জায়গাটাও কত আরামের। সাইকেলরডের মত অমন শক্ত খটখটে নয়  নীরদজ্যেঠুদের বৈঠকখানার সামনে থেকে যুঁইরা হেঁটেই পাড়ার মধ্যে ঢুকে যে যার বাড়ী চলে যায় যুঁইয়ের একটু একটু ভয় ভয় লাগতে থাকে --- মা যদি জানতে পারে, কী করবে! এমনিতেই তো কথায় কথায় বলে ": হইতাস তো অরুণার লাহান'! এত খারাপ লাগে যুঁইয়ের এই তুলনাটা কেন অরুণাদির মত হবে? অরুণাদি নাকি নিজে নিজেই বিয়ে করে নিয়েছে! কি লজ্জার কথা! অরুণাদি নাকি বাড়ী এসেছিল, ওর মা দেখা করে নি, মুখে কাপড় ঢাকা দিয়ে ঘরে শুয়েছিল ওর বাবা এসে চীৎকার করে বের করে দেয় ওদের বাড়ী থেকে সেই থেকে কোন কাজ অপছন্দ হলে মা অরুণাদির সাথে তুলনা দেয়, যুঁইয়ের গাল কান গরম হয়ে যায়, কিন্তু মা'কে কিছু বলতে সাহস পায় নাবাড়ী ঢুকে দেখে দাদা সেজদা এসেছে কলকাতা থেকে, মেজদা কলকাতায় থেকে গেছে  পরীক্ষা কিনা শীতের ছুটিতে এখন সব স্কুল কলেজ বন্ধ, ওরা তাই এই সুযোগে কদিন বাড়ীতে থেকে যাবে যুঁই তাড়াতাড়ি হাতপা ধুয়ে শাড়ী বদলে রান্নাঘরে যায় মা'কে সাহায্য করতে মাও বেশ খুশিখুশি ওকে বলে লুচিগুলো বেলে দিয়ে গিয়ে পড়তে বসতে "আইচ্ছ্যা' বলে কাজে লেগে যায়, মনে মনে ভাবে এখনও তো সন্ধ্যে হতে দেরী আছে, তবে আগে আগে পড়া করে নিলে দাদাদের কাছে বসে গল্প শুনতে পাবে


যুঁইদের সারা মাসের চালডাল, তরি তরকারী আসে দেশের বাড়ি, জঙ্গলবাড়ি থেকে৷ ওখানে মণিকাকা থাকেন৷ সারাবছর তদারকি করে জমিজিরেত দেখভাল্ করেন, প্রতি তিনমাসে চাল পাঠান, ডাল আসে বছরে দুবার আর মাসে মাসে ঠিক চলে আসে কিছু শাকসবজি আর সময়ের ফল৷ বাড়ীতে অতিথি এলে বাবা কিশোরগঞ্জ বাজারে যায় নিশি-চাকরকে সঙ্গে নিয়ে৷এমনিতে বাজার যাওয়ার তেমন দরকার পড়ে না৷ দেশের বাড়ী থেকে যা এলো তো এলোই৷ রোজের তরকারী, মাছ বাড়ীতেই রাখা হয়৷ নইল্যা আসে মাছ নিয়ে৷ বাবা ভেতরবাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়, মা দেখে দেখে রাখে৷ যতদিন দাদু বেঁচে ছিল বারবাড়ীর বারান্দায় বসে থাকত সারা সকাল আর দেখে মাছ, দুধ সব রাখত৷ নিশিকে দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিত৷ মা নিয়ে ঠিকঠাক ব্যবস্থা করত৷ দাদুর কথা মনে পড়লেই যুঁইয়ের মন খারাপ লাগতে থাকে।  দাদু ওকে খুব ভালবাসত৷ মা কিন্তু দাদুকে খুব ভয় পেত৷ দাদু কালাজিরা চালের ভাত খেত, সেই ভাত বসানো হত দাদু যখন তেল মেখে পুকুরঘাটের দিকে যাবে, তখন৷ দাদু চান করে এসে পাতে বসবে আর মা বেড়ে দেবে গরম ঝরঝরে ভাত৷ একটুও আগেপরে হওয়া চলবে না৷ হলে কী হবে? তা কেউ জানে না৷ শুধু মা যখন মামাবাড়ী যেত তখন দিদিমণিকে বলত 'তাইন যহন পুকুরের লাহান যাইবো তহনই ভাত বসানি লাগবো, একটুও আগেপরে হওনের উপায় নাই' দিদিমণিও ঘাড় নেড়ে বলে ' আগের দিনের লুক তো ত্যাজটা খুব আসে অহনও' সেবারে মামাবাড়ী থেকে ফিরে যুঁই যখন ভেলুকে আদর করতে গিয়ে কামড় খেল; আসলে ভেলু কী করে যেন ওর চেনের সাথে জড়িয়ে গেছিল, যুঁই বোঝে নি গলা জড়িয়ে আদর করতে গেছে আর অমনি ভেলু দিয়েছে ঘ্যাঁক করে ওর নাকের পাশে দাঁত বসিয়ে; যুই  কাঁদতেই মা ভীষণ বকতে শুরু করেছিল আর অমনি দাদু ডেকে উঠল 'বৌমাআ' ব্যাস! মা একদম চুপ৷ শুধু যুঁইয়ের দিকে রাগীচোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করছিল৷ দাদু তারপর লাঠি নিয়ে বেরোল সঙ্গে নিশির কোলে যুঁই, রমেন ডাক্তারের ডিসপেন্সারিতে গিয়ে কি যেন একটা অ্যাসিড দিয়ে নাকের পাশটা ভাল করে মুছে দেওয়া হল৷ সাইট্রিক অ্যাসিডনা না নাইট্রিক অ্যাসিড বোধহয়৷ এই নামটা ওর কিছুতেই মনে থাকে না আর মেজদা আর সেজদা খালি 'বলদা  বলদা' বলে খ্যাপায়৷ উফ! কি ভীষণ জ্বালা করেছিল৷ যুঁইয়ের জোরে চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ভয়ে পারে নি৷ মা যদি আড়ালে পেয়ে মারে! অসুখ বিসুখ করলে মা বড্ড রাগ করে৷  দাদু আর বাবা অনেকক্ষণ ইংরিজিতে কিসব আলোচনা করেছিল, যুঁই বুঝতে পারে নি, শুধু 'গার্ল চাইল্ড' শব্দটা বারবার শুনেছিল৷ এটার মানে জানে, ছোটমেয়ে, আর 'ডেঞ্জার' মানে বিপদ তাও জানে ও৷ অ্যাসিড দিয়ে মোছানোর জন্য ওর নাকের পাশে একটা ছোট টোলমত গর্ত আছে৷ ওকে অবশ্য আর ইঞ্জেকশান নিতে হয় নি৷

-
রান্নাঘর থেকে এসে বই নিয়ে বসে যুঁই।  সেজদা এসে ওর খোঁপাটা নেড়ে নেড়ে জিগ্যেস করে কি বিদুষী কী পড়তেসেন আপনি?  সেজদা ওদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে দুরন্ত, তারপরই মেজদা৷ আরও ছোটবেলায় সেজদা যখন বাড়ীর প্রায় উল্টোদিকে বিপিন পন্ডিতের পাঠশালায় পড়তে যেত, তখন একটু বেলা হয়ে গেলেই ওদিক থেকে চীৎকার করত 'দাদুউ আমারে অহনও ছুটি দেয় নাআ'; আর অমনি দাদু এদিক থেকে বলত 'বিপিন ভানুরে ছাইড়্যা দাও' ব্যাস সেজদাও অমনি কোনোদিকে না তাকিয়ে, পণ্ডিতমশাই ছুটি দিলেন  কিনা না দেখেই একদৌড়ে রাস্তা  পেরিয়ে বাড়ী৷ মেজদা আর সেজদা মিলে প্রায়ই নরশুন্দা নদীতে নৌকা বাইতে যেত৷ কোন মাঝি নৌকা রেখে একলা একলা বসে আছে দেখলেই ওরা সেই মাঝির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করত, আর ভাব জমে গেলেই নৌকা নিয়ে ভাসা৷ ওরা  প্রায়ই ঐপারে যেত, কিন্তু নামত না৷ ভদ্রবাড়ীর ছেলেদের নাকি ঐপারে নামতে নেই৷ তবে মেজদা, সেজদার গল্প শুনে যুঁই বুঝেছে যে ওরা ওপারে নামে, ঘুরে ফিরে দেখে, এমনকি ওপারে ওদের বন্ধুও আছে৷ একবার এক মাঝি কিছুতেই নৌকা দিতে রাজী হল না৷ মেজদা ঠিক করে ওকে শাস্তি দিতে হবে৷ তক্কে তক্কে থাকে৷ একদিন মাঝি নৌকা বেঁধে রেখে নদীতে নেমেছে প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে৷ নরশুন্দায় বর্ষা ছাড়া সারাবছরই প্রায় কোমরজল বা বুকজল থাকে৷ এই বর্ষাতেই যা একটু নৌকা চলে৷ তা, নৌকা খালি দেখে মেজদা আস্তে আস্তে নৌকায় ওঠে৷ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে একটা শিশিভর্তি মধু৷ : মধু বড় ভাল জিনিষ, তাড়াতাড়ি শিশি খুলে ঢকঢক করে অনেকটা গলায় ঢেলে দিয়েই দৌড়ে নেমে যায়৷ আর তারপর --- কিছুক্ষণ পরে ভানু দেখে মেজদা প্রাণপণে জল খাচ্ছে, তার চোখমুখ লাল, নাকচোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছে৷ রাতে বৈঠকখানায় বাবা সবাইকে ডেকে খুবই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল 'সুহাষ তুই মাঝির ত্যাল খাইলি ক্যান?' মাঝি এসে নালিশ করে গেছে৷ যে কোন ঝগড়ায় মেজদাকে জব্দ করার বা থামিয়ে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র ভাইবোনেরা পেয়ে গেল৷ ওরা  শুধু  বলত 'তর সেই মাঝির ত্যাল খাওয়ন ---- ' ব্যাস! মেজদা কখনও বলে মাঝি তেলটা অন্য কোথায়ও ফেলেছে, সে আসলে মধুই খেয়েছিল৷ কখনও বলে ইচ্ছে করেই তেল খেয়েছিল৷ মোটকথা সুভাষ যে মাঝির ত্যাল খাইসিল এই নিয়ে নরশুন্দার কুচো মাছগুলোরও কোন সন্দেহ ছিল না৷

কাল ১৯৪৮ সাল ডিসেম্বর মাস ২৪ তারিখ

তিনভাইবোনে মাকে নিয়ে বাজিতপুরের দিকে রওনা হয়ে গেল।  মা  বিশেষ হাঁটতে পারছেন না,  গরুর গাড়িতে যুঁই রইল সঙ্গে যদি হঠাৎ খারাপ লাগে শরীর। যোগেশ এককথায় আকরম আলির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন,  দেশ ছাড়ার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। তাঁর অনাগত সন্তানকেও তিনি তাঁর পিতৃপুরুষের দেশেই বড় করে তুলতে চান। তবে মনীশের সিদ্ধান্তে তিনি বাধা হবেন না,  আলিসাহেব ও তাঁর ভাইকে লোক দিয়ে জঙ্গলবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন  সেইদিনই মীর্জাপুর স্ট্রীটের মেসবাড়ির বাসিন্দারা কিছু বেশী উত্তেজিত ছিলেন;  কাগজে বেরিয়েছে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় মসজিদের ভিতরে রামলালার মূর্তি পাওয়া গেছে -- গোবিন্দগোপাল জোরে জোরে বলেন দেখেছ  নাথুরাম গডসের লোকেরা  বহুদিন ধরেই বলে আসছিল ওইটা আসলে  অযোধ্যায় দশরথের প্রাসাদ ছিল, দেখলে তো তোমরা। ব্যাটা বাবর ধ্বংস করেছিল  ননী ফুট কাটে  হ্যাঁ কৌশল্যার আঁতুড় ছিল ওখানে। মহা ঝামেলা  বেধে যায়।   কেউ বলে বাবর নয় ঔরঙ্গজেব মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ বানিয়েছিল, কেউ বলে না বাবর।  এর মধ্যেই ম্যানেজারবাবু এসে বলে যান আজকে আর রাজাবাজারের দিকে না যাওয়াই ভাল বলা তো যায় না ---। সুহাষ মনে মনে ভাবে  এই খবরগুলো নিশ্চয়ই পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছায় নি,  হে মা ঠনঠনে কালী এসব খবর যেন ওদিকে না পৌঁছায় ......

কালপঞ্জী
৩০/০১/১৯৪৮ মহাত্মা গান্ধী হত্যা
১২/০৯/১৯৪৮  - মহম্মদ আলী জিন্নার মৃত্যু
১৫/১২/১৯৪৮ নাথুরাম গডসে, নারায়ন আপ্তের ফাঁসি
২১/১২ ২৩/১২/৪৮ অযোধ্যা মসজিদে  মুর্তি আবিষ্কার 

2 comments:

  1. এক পর্ব শেষ হয় আর এক অপেক্ষার শুরু হয়

    ReplyDelete
    Replies
    1. পরেরটা তাড়াতাড়ি পাবে। এটা আটকে ছিল ঠিক রেফারেন্সের জন্য

      থ্যাঙ্কুউউউ আবারো

      Delete