খোঁজাখুঁজি

Sunday, September 3, 2017

সিজনস অব বিট্রেয়াল – তৃতীয় পর্ব

প্রথম পর্ব   দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব   চতুর্থ পর্ব  


স্থান কলকাতা শহর   কাল ১৯২৭ সাল অক্টোবর মাস

-
টুনু যখন জন্মায়, তখন প্রমদাকান্ত আর সরলাবালা দুজনেই খুব আশা করেছিলেন এবার ছেলে হবে৷ আশা অবশ্য তাঁরা প্রতিবারই করেন৷ রুনু , ঝুনুর সময়ও করেছিলেন৷ কিন্তু এবারে কেন যেন মনে হয়েছিল ভগবান নিশ্চয়ই একটা ছেলে দেবেন৷ মানদা দাসীর তীক্ষ্ণকন্ঠ যেই ঘোষণা করল "মেয়ে হয়েচে গো' টালিগঞ্জের বাড়ীটা হঠাৎই চুপচাপ, শান্ত হয়ে গেল৷ সরলাবালার বাপেরবাড়ীতে এমনিতে লোকের কোন কমতি নেই৷ মা, তিনভাই, ভাইবৌ, তাদের তেরটি ছেলেমেয়ে ----- সর্বদাই হট্টমেলা হয়ে থাকে৷ এছাড়া দেশেরবাড়ী পাবনা থেকেও আসোজন বসোজন লেগেই আছে৷ অক্টোবরের এই শুরুর দিকটায় অবশ্য ভাই ভাইবৌরা কেউ নেই৷ সবাই  দুর্গাপুজা উপলক্ষে গেছে পাবনায়৷ শুধু মা অনিলাবালা থেকে গেছেন আসন্নপ্রসবা সরলার জন্য৷ প্রমদাকান্তও দুদিন এখান থেকেই অফিস করছেন৷


রাইটার্সের সামান্য কেরাণী প্রমদাকান্ত, বড় দুই মেয়ের বিয়ের ভাবনাতেই কাহিল হয়ে থাকেন, আবার একটা মেয়ে৷ একটাও কি পাশে দাঁড়াবার মত কেউ জন্মাতে নেই! আর এই তো দেশের অবস্থা! যখন তখন স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে! আরে তোরা পারবি শক্তিশালী ইংরেজদের সাথে? আর সত্যি তো ইংরেজরা না দেখলে এই দেশটার কি হাল ছিল সে তো  জানাই আছে৷ এইসব ভাবনার মধ্যে মানদার চাঁছাছোলা গলা ভেসে আসে " রুনু মায়ের কাছে একটু বোস দিকি, আমি খুকীটারে একটু পোস্কার করে নিই' জলের স্পর্শে নবজাতিকা তীক্ষ্ণকন্ঠে কেঁদে ওঠে আর মানদার গজগজ চলতে থাকে "থাক থাক আর কাঁদে না --- তো মেয়ের ঢিপি -- তার আবার অত আদিখ্যেতা কিসের? সাড়ে বছরের রুনু ঠিক বুঝে যায় এই বোনটা একেবারেই অবাঞ্ছিত৷৩ বছরের  ঝুনু অতশত বোঝে না, বোনকে দেখতে চায়, হাত বাড়াতে যায় ------ মানদার ঝঙ্কারে ভয় পেয়ে সেও বোধহয় নিজের মত করে বুঝেই যায় যে বোনটা এমনকি তার চেয়েও বেশী অনাকাঙ্খিত৷ সরলাবালার জ্ঞান আছে কিনা বোঝা যায় না, চুপচাপ পড়ে থাকেন৷শুধু অনিলাবালা বলতে থাকেন ভগবান যা দেন তাই হাত পেতে নিতে হয়৷ অশ্রদ্ধা করতে নেই৷ তবে বাড়ীতে জামাই আছে, তাই গলা তেমন চড়ে না৷

-
সাড়ে নয় বছরের টুনুর মাথায় পড়াশোনা তেমন ঢোকে না৷ কদিন ধরেই বাবা চেষ্টা করছে ভাগ শেখানোর৷ কিন্তু বুঝতেই পারছে না৷ প্রমদাকান্ত আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন না৷ এই নিয়ে চারদিন হয়ে গেল ----- রোজ একবার করে দেখিয়ে দেন আর এই মেয়ে ঠিক কিছু না কিছু ভুল করে! এর মাথায় আছেটা কি? অথচ খোকনকে দেখো, কেমন চটপট সব শিখে নেয়৷ টুনুর চেয়ে তিন তিনটে বছর ছোট অথচ এই বয়সেই যোগ আর বিয়োগ দিব্বি পারে৷ একটু লেখাপড়া শিখলে অন্তত বিয়ের চেষ্টা করতে সুবিধে হয়৷ আজকাল আর অশিক্ষিত মেয়েদের কেউ বিয়েও করতে চায় না৷ আসলে অমনোযোগ --- দিব্বি বাপের ঘাড়ে খাচ্ছে দাচ্ছে ---- প্রমদাকান্ত ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেন টুনুর গালে৷ টুনু ঘরের মধ্যে চৌকীর ওপর থেকে সোজা বারান্দায় গিয়ে পড়ে, মাথাটা ঠুকে যায় দেওয়ালে, চোখে অন্ধকার দেখে৷ ভবানীপুরের এই বাড়ীটার দেওয়াল, মেঝে বড় ঠান্ডা, টুনুর আর উঠতে ইচ্ছে হয় না মেঝে থেকে৷  খোকন ভয়ে চীৎকার করে কেঁদে ওঠে৷ সরলাবালা  এসে স্বামীকে একটু অসন্তুষ্টভাবেই মনে করিয়ে দেন যে মেয়ে একেই তো কালীতারা, রূপের ধুচুনি, তায় যদি  খুঁতো হয়ে যায় তাহলে কিন্তু বিয়ে দিতে আরও সমস্যা হবে৷আর পাত্র কেনার মত টাকার জোরও তাঁদের নেই৷ প্রমদাকান্ত গুম হয়ে যান৷ ঝুনু বোনকে উঠিয়ে বসায়, সরলা আঁচল ভিজিয়ে মাথার ফোলাটায় লাগিয়ে দেন৷ টুনু কেঁপে কেঁপে ওঠে --- কাঁদে না কিন্তু৷ সেদিন আর পড়তে হয় না ওকে৷ আর কি আশ্চর্য্য! পরেরদিন ভাগ অঙ্ক সে একদম নির্ভূল করে৷ পরে "এক চড়ে ভাগ শেখানোতাদের বাড়ীতে একটি  গল্পকথা হয়ে যায়৷

শিবপুরের এক পুলিশ কনেস্টবলের সাথে রুনুর বিয়ে দেন প্রমদাকান্ত৷ ছেলেটি ভাল, প্রায় কোন দাবীদাওয়াই ছিল না৷ ঝুনুর বিয়েরও চেষ্টা চলছে৷ ঝুনু দিব্বি ক্লাস এইটে উঠে গেছে, টুনু আর খোকনও পড়ছে৷ তবে টুনুর সব শেখাই ঠেকে ঠেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতে থাকে৷অনেকগুলো দিন চলে যায়, ঝুনুরও বিয়ে ঠিক এক মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভের সাথে৷পরিবারটি বেশ বড় খুবই ভাল৷ পড়াশোনা যে যেমনই করুক ঘরের কাজ সরলাবালা সব কটি মেয়েকেই যত্ন করে শেখান। ঝিরি করে কেটে আলুভাজা, সমান করে কেটে পাঁচ রকম তরকারী দিয়ে পাঁচমিশালি তরকারি রান্না করতে টুনুও শিখে গেছে। টুকটাক ভাত রুটি বানানো দুধটা গরম করা, বাড়ীতে লোক এলে ঝপ করে কয় কাপ চা বানিয়ে দেওয়া এসবও দিব্বি পারে। তবু এর মধ্যে কেমন করে কে জানে আচমকাই একদিন রান্নাঘরে গরম জলের হাঁড়ি টুনুর গায়ে উল্টে পড়ে৷ একেবারে ফুটন্ত গরম জল ---- আর সরলাবালার আশঙ্কা সত্যি করে বুকপেটের বিস্তীর্ণ অংশ পুড়ে চামড়া গুটিয়ে যায়, বাঁ হাতে কনুইয়ের ভেতর দিক থেকে কবজির ভেতর দিক অবধি চামড়া জুড়ে যায়, বাঁ হাতের তিনটি আঙুলও হাতের তেলোর সাথে জুড়ে জুড়ে যায় ,যেগুলি আর কোনওদিনই ঠিক হয় নি৷চিন্ময় ডাক্তার প্রমদাকান্তকে পরামর্শ দিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজে নিয়ে যেতে কিম্বা পিজি হাসপাতালে, সেখানে নাকি কি এক প্লাস্টিক সার্জারি করে এইসব অনেকটা   ঠিক করা যায়। কিন্তু খরচের যা আন্দাজ ডাক্তার শোনালেন তাতে আর  সেসব কথা মনেও আনেন নি প্রমদাকান্ত।  মনে মনে টুনুর মৃত্যুকামনা করেছিলেন কিনা জানা যায় না,তবে প্রকাশ্যে প্রমদাকান্ত কিছু বলেন নি৷ সরলাবালা কিন্তু অসাবধানের জন্য  টুনুকেই দায়ী করেন৷ সকালে বিকালে সেকথা জানিয়েও দেন৷ অনিলা শুধু আপশোষ করে বলেন  সংসারে যার পাশ ফিরেও জায়গা হতে চায় না, তার সেই জায়গাটুকুই কিছুতেই আর খালি হতেও চায় না৷

স্থান কলকাতা  কাল ১৯৪৮ সাল মার্চ মাস
-
ইতিমধ্যে ভারত স্বাধীন হয়েছে, সন্ধ্যে হলেই ব্ল্যাক আউট দিবারাত্রিব্যপী দাঙ্গার দিন পেরিয়ে স্বাধীন মুক্ত স্বদেশে প্রমদাকান্তের পক্ষে দুবেলা সকলের মুখে খাওয়ার জোটানোই এক বিরাট সমস্যা৷ পাবনা থেকে প্রায় সবাই চলে এসেছে, শুধু কৃষ্ণকান্ত নিয়মিত যাওয়া আসা করেন, "শত্রুসম্পত্তি' বাবদ টাকাপয়সা তিনিই এনে ভাইদের ভাগ করে দেবেন৷ বড়দাদার ওপরে সবাই নির্ভর করে, বিশ্বাস করে৷ পাবনার আত্মীয়, অনাত্মীয় বহু লোক আসে কলকাতা আর ওঠে এসে প্রমদাকান্তের বাড়ীতেই। বাড়ীর দেড়খানা ঘর নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে বাকী আড়াইখানাই ছেড়ে দিতে হয়েছে সম্প্রতি বিদেশ হয়ে যাওয়া দেশ থেকে আসা লোকজনের জন্য। ঘরদোর বিছানাপত্র নাহয় ব্যবস্থা হয়েই যায়, কলঘরের কাজও আগেপরে করে একরকম করে সেরে নেওয়া যায়, কিন্তু রোজ অন্তত তিনবেলা করে সবাইকে  খেতে দেওয়াই ক্রমশঃ সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দীর্ঘকাল কলকাতায়  থেকে সকাল সকাল অফিস বা স্কুলে যাবার তাড়ায় ওঁরা ভারী কিছু খান না, চা বিস্কুট বা একগাল মুড়ি। কিন্তু দেশ  থেকে আসা মানুষদের সকালে একথালা ভাত খাওয়া অভ্যাস, সরলাবালা জানেন তা, দিয়ে যাচ্ছেন যতদিন পারছেন।  কিন্তু তিনি বোঝেন  প্রমদাকান্ত আর পেরে উঠছেন না, বাজারে ইতিমধ্যেই অনেক ধার হয়ে গেছে। আত্মীয়রা কেউ কেউ প্রথমদিকে খোরাকি বাবদ টাকা দিতে চাইতেন, তখন তিনি নেন নি; নিতে পারেন নি, এই অসহায় অবস্থায় ভেসে আসা মানুষগুলোর হাত থেকে খোরাকি নিতে তাঁর মন সায় দেয় নি --- কিন্তু এখন যে চোখে অন্ধকার দেখছেন। খবর পেয়েছেন কৃষ্ণকান্ত রানাঘাটে পাঁচবিঘে জমির ওপরে বাড়ী, পুকুরসহ কিনেছেন।  থিতু হয়ে বসেন নি এখনও,  তবে এখন এদেশেই আছেন। রোজই বাড়ী ফেরার সময় প্রমদাকান্ত মনে মনে আশা করেন আজ হয়ত ফিরে গিয়ে দেখবেন কৃষ্ণকান্ত এসেছেন, দেশের জমিজায়গার   বিলিব্যবস্থা কিছু তো হয়েইছে --- সেসবের কিছু অংশ পেলেও ধারগুলো সামাল দেওয়া যায়, নাহলেও কৃষ্ণকান্তের অবস্থা ভাল --- কিছু যদি অন্তত ধার দেন --- ভাবতেও লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে প্রমদাকান্তের, অথচ উপায়ও তো নেই বিশেষ, মেজ মেয়েটার বিয়ে সামনে মনে মনে স্থির করেন এই রবিবার তিনিই যাবেন একবার রানাঘাট।

মাঝে বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর টুনু আবার স্কুলে যেতে শুরু করেছে, শাড়ি পরতে এখনও ওর খুব কষ্ট হয়, একহাতে পুরোটা ঠিক করে ধরতে পারে না। ঝুনুর হাত খালি থাকলে যত্ন করে পরিয়ে দেয়। আর এখন তো রাত থাকতে উঠে কলঘরের কাজ সমস্ত সেরে স্নান করে আসতে হয়, নাহলে আবার সেই বেলা দুপুর হয়ে যাবে ফাঁকা পেতে পেতে। ভোর তিনটে, সাড়ে তিনটেয়  প্রথম ট্রাম যখন বড়রাস্তা দিয়ে টিং টিং করে ঘন্টা বাজিয়ে যায় তখনই সরলাবালা  নিজে ওঠেন, ডেকে দিয়ে যান ঝুনু আর টুনুকে। উনি বেরোলেই ওরা পরপর ঢুকে যায়কোনো কোনোদিন মনিপিসি বা চুনিকাকা উঠে পড়ে, সেদিন ঝুনুরা অপেক্ষা করে। খোকন যায় রাস্তা পেরিয়ে তারপর গলি পেরিয়ে মিত্র ইনস্টিটিউশনে, টুনুকে রাস্তা পেরোতে হয় না ভেতর দিয়ে দিয়ে জগুবাজারের  দিকে চলে গেলেই এগলি সেগলি করে ওদের ইস্কুল।  ঝুনুর বিয়ের কথা প্রায় পাকা  তাই সরলাবালা এখন আর ঝুনুকে খুব একটা বাড়ী থেকে বেরোতে দেন না। টুনু যাবে নীচের শোভামাসির মেয়ে বকুল, আর পাশের বাড়ীর   অণিমার সাথে। বকুলের কথা মনে হতেই টুনুর হঠাৎ খুব ভয় ভয় করে। বকুলরাও  টুনুদের মতই এই বাড়ীটায় ভাড়া থাকে, টুনুরা দোতলায় বকুলরা একতলায়। বকুলের বাবা গাড়ির টায়ারের ব্যবসা করেন, গলির মোড়ে বড়রাস্তায় দোকান আছে ওদের। গত কয়মাস হল সেই দোকানে কতগুলো পাঞ্জাবী এসে কাজে ঢুকেছে। ওদের কথা মনে হলেই টুনুর ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়। সক্কলের মাথায় মস্ত মস্ত পাগড়ি, গালে ইয়াম্মোটা চাপদাড়ি হাতে বালা আর সবছেয়ে ভয়ের যেটা কোমরে ঝোলানো তলোয়ার। বাবা বলে ওরা নাকি শিখ আর ওইটে তলোয়ার নয় কৃপাণ, ওদের ধর্মের অঙ্গ। বাবার যেমন গলায় পৈতে ওদের তেমনই নাকি কৃপাণ, ও দেখে ভয় পেতে নেই। কিন্তু বাবা তো আর জানে না ওদের গল্প।

এই পাঞ্জাবীদের মধ্যে যিনি  সবচেয়ে বুড়ো তাঁর দাড়িগোঁফ ভুরু সব ধবধবে সাদা আর চোখ খুব তীক্ষ্ণ জ্বলজ্বলে। প্রথম যেদিন স্কুলে গেলো ওরা সেদিন একটু ঘুরে বড়রাস্তা দিয়ে ফিরেছিল। বুড়ো মানুষটি বসেছিলেন খাটিয়ায় একদম সোজা হয়ে কৃপাণটি হাতে নিয়ে। টুনু তাঁকে দেখে সেদিনই বেশ ভয় পেয়েছিল, অণিমা বকুলরাও ভয় পেয়েছিল খানিক। পাঞ্জাবীরা থাকে ওদের গলির মুখে ছোট্ট একটা ঘরে ওই বুড়ো মানুষটিসহ চারজন পুরুষ, ওদের সঙ্গে কোনো মহিলা বা বাচ্চা ছিল না। কয়েকদিন বাদেই বকুল ওদের শোনায় এক  অবিশ্বাস্য কাহিনী, ওর বাবা কাকারা দোকানে শুনেছে ওই পাঞ্জাবী যুবক ও প্রৌঢ়দের কাছে। ওদের দেশের বাড়ী ছিল রাওয়ালপিন্ডির কাছে একটা গ্রামে। পিন্ডি-- পিন্ডি --- টুনু খিলখিল করে হাসে কেমন মজার নাম, ঝুনু আস্তে করে বকা দেয় ওকে। বকুল কোনোদিকে কান না দিয়ে কেমন ঘোরের মধ্যে বলে যায় দেশ স্বাধীন হবে এটা ঠিক হওয়ার আগেই দেশ ভাগ হবে এটা নাকি ঠিক হয়ে গেছিল ওদের ওইদিকে।  ওরা শুনতে পায়  হিন্দুদের আলাদা দেশ আর মুসলমানদের আলাদা দেশ হবে। তাহলে শিখদের কী হবে? কেউ খুব গুরুত্ব দেয় না এই প্রশ্নের, ধরেই নেওয়া হয় তারা হিন্দুদের সাথেই থাকবে। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত  এই করণবীর, ধরমবীর, কমলজিৎ ওই বৃদ্ধ অমরিন্দর এঁরা ভেবেছিলেন দেশের রাজা বদলায়, দেশ কী করে বদলাবে? তাই কি সম্ভব?  দেশের লোক যে যেখানে আছে তেমনই থাকবে --- স্বাধীন হলে হয়ত একটু ভাল থাকবে হয়ত বা একটু খারাপ, রাজা বদলাচ্ছে তো, কিন্তু  ওঁরা যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। তাই প্রথম যেদিন  শুনলেন বিভিন্ন দিকে গন্ডগোল হচ্ছে, দাঙ্গা হচ্ছে তখনও নিজেদের গ্রামের মেয়ে ও শিশুদের  সুরক্ষার জন্য  গ্রামেরই গম পেষাইয়ের কলটায় দরজাটা একটু মজবুত করলেন পাঁচজনে মিলে আর কিছু লাঠি শড়কি কৃপাণ জড়ো করলেন, কয়েকটা বন্দুকও এদিক সেদিক থেকে যোগাড় হলকিন্তু ১৯৪৭ এর মার্চে শুরু হওয়া ঝামেলা জুলাইয়ে চরম আকার ধারণ করল। অবশেষে অগাস্টের শুরুতে ওঁদের গ্রামেও শুরু হল হামলা। যোগাড় করা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দুটো রাত ঠ্যাকানো গেল বটে, কিন্তু বোঝা গেল যে তৃতীয় রাত কাটবে না। আর তখনই নেওয়া হল সেই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত। অমরিন্দর স্থির করলেন বাড়ীর সমস্ত মেয়ে ও শিশুকে তিনি বলি দেবেন এবং সমর্থ পুরুষরা পালাবেন। এই পর্যন্ত শুনে আঁতকে ওঠে টুনুরা সকলে,   মেয়েরা পালাল না কেন? নাহ তারা সকলেই শহীদ হতে চেয়েছিল, তারা নাকি কেউই চায় নি মোসলারা তাদের নষ্ট করুক।  পালাবে যে, রাস্তায় কত বিপদ আছে কেউ জানে? কোথায় যাবে?  সেখানে কী করবে? মাঝপথে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন তো মেয়েদের বা বাচ্চাদের সম্মান রক্ষা করার কেউ থাকবে না, তাই সবদিক ভেবেচিন্তেই অমরিন্দর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাড়ীর সক্কলের সায় ছিল তাতে। মেয়ে ও বাচ্চা মিলিয়ে  মোট ষোল জন শহীদ হন তাঁদের পরিবারে। একতলার ছাদে অমরিন্দর প্রথমে বসে শান্ত হয়ে প্রার্থনা করেন নিজ পরিবারের সম্মান, একজন  শিখ কূলপতির সম্মান, শিখখি  রাখতেই তিনি এতগুলি প্রাণ নিবেদন করতে যাচ্ছেন তাঁর ভগবানকে, তিনি যেন এই নিবেদন নিয়ে তাঁর কূলের সম্মান বজায় রাখেন। এরপরে হাতে তুলে নেন কৃপাণ একবার পাথরে ঘষে নেন কি? জানে না বকুল --- সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে তাঁর মেয়ে কমলজিৎএর ভাষায় সে মেয়ে কমলকলির মত সুন্দর --- স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে হাঁটুমুড়ে বসে, এগিয়ে দেয় মাথা--- ঘাড় নীচু করে --- অমরিন্দরের কৃপাণ ওঠে পড়ে কিন্তু নাহ আটকে গেছে মেয়ের মস্ত বিনুনী আর মাথাঢাকা ওড়নায় ঘাড় উঁচু করে তাকায় মেয়ে  -- বাবার হাত থেকে টেনে নেয় কৃপাণখানা, সেও শিখকন্যা, সম্মানহানির সম্ভাবনাও তার কাছে মৃত্যুর হাজার গুণ বেশী ভয়ংকর,  এক ঝটকায় ওড়না ফেলে কোমরে জড়ায় বিনুনীখানা সামনে টেনে এনে কাঁধ বরাবর এককোপে কেটে ফেলে দেয় পাশে।  আবার ঘাড় নীচু করে বসে--- এবার অমরিন্দরের কৃপাণ নির্ভুল নামে --- কমলকলির  মত মুখটি ছিন্ন হয়ে গড়িয়ে আসে করণবীরের পায়ের কাছে রক্ত ছিল কতটা কি তা আর দেখতে পারে নি সেই আঠেরোর বালক, শুধুমাত্র আঠেরো বয়স হওয়ায় আজ যার প্রাণ যাবে না বলে স্থির হয়েছে ---- কোনওমতে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় তার চোখে লেগেছিল ছিটকে গড়িয়ে আসা কমলকলির মত এক মুখ আর কানে লেগেছিল স্যুউউইইশশ দ্ধাআপ আওয়াজ --- পরের পর কৃপাণ ওঠা নেমে আসা নির্ভুল লক্ষে।


এরপরে তাঁদের হাতে আর বেশী সময় ছিল না, দেহগুলি বাড়ীরই কুয়োতে কোনমতে ফেলে দিয়ে ওঁরা পালান এপথ সেপথ, এগ্রাম সেগ্রাম, এই শহর সেই শহর করতে করতে ওঁরা কজন এসে ঠেকেছেন এই কলকাতায়।  গ্রামের কিছু লোকজন হয়ত বা দিল্লী গেছেন কিছু হয়ত বা  অমৃতসর জানেন না ওঁরা। আসার পথে ওঁরা দেখেছেন মানুষ অকাতরে মেরে ফেলছে কেটে ফেলছে মানুষকে --- ইনসানিয়াত গুম হো গ্যয়া, বিলকুল গায়েব হো গ্যয়া তাই ঘুমের মধ্যেও অমরিন্দরের হাতের মুঠিতে কৃপাণ শক্ত করে ধরা থাকেশহর কলকাতা --- উদ্বাস্তু মানুষের  ভারে টলমল করা কলকাতা বিনাপ্রশ্নে  আশ্রয় দেয় তাঁদের। 

2 comments:

  1. বুক কেঁপে উঠল দ্বিতীয় অধ্যায়ে

    ReplyDelete