খোঁজাখুঁজি

Sunday, February 28, 2010

এবড়ো খেবড়ো রং - ৩


--
বিগত এক দশকে প্রতি ২-৩ বছরে জায়গা বদলে বদলে এমন অভ্যাস হয়েছে যে কোথাও ২ বছর হলেই মনে হয় বাব্বা: কত্তদিন হয়ে গেল এখানে! তা পুণেতেও নয় নয় করে আড়াইবছর হয়ে গেল৷ এ শহর ভাল লাগে আবার লাগেও না৷ পাহাড় আমার বড় পছন্দের বিষয়৷ এ শহরের এদিক ওদিক থেকে উঁকিমারা পাহাড়দের তাই বড় ভাল লাগে৷ শহরের লোকগুলো এমনিতে শান্ত নিরীহগোছের,
কিন্তু সাধারণভাবে বড্ডই অলস আর গোঁড়া মানসিকতার৷বসবাস করার পক্ষে একটু অসুবিধেজনকই লাগল আগাগোড়া৷ কলকাতায় ফেরার সুযোগ খুঁজছিলাম অনেকদিন ধরেই৷ মাঝখানে মন্দা এসে সমস্ত পরিকল্পনা চৌপাট করে দিয়েছিল৷ চাকরিবাকরির বাজার আবার আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, খালিপকেট ক্লায়েন্টরাও পকেটে যা দু'চারপয়সা আছে তাই দিয়েই অল্পস্বল্প করে কাজ দিচ্ছে, কাজেই এবারে ব্যবস্থা করেই ফেলা গেল৷অবশ্য ব্যবস্থা হয়ে আছে সেই গত অক্টোবর থেকেই, কিন্তু এখান থেকে আর ছাড়েই না--- ছাড়েই না৷ শেষমেষ জানুয়ারীতে ছাড়া পেলাম, কিন্তু গোটা ফেব্রুয়ারী স্রেফ বসে রইলাম৷ একই কোম্পানির অন্য শহরের শাখায় যেতে যে এত সময় লাগতে পারে তা জানা ছিল না৷ প্রোজেক্ট অ্যালোকেশান হয়ে গেছে সেই মাস পয়লাতেই, এদিকে বদলী আর হয় না৷ আমি শোষিত হতে ইচ্ছুক, শোষকরাও শোষণ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু স্রেফ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় গোটা একটামাস চুপ করে বসে থাকতে হল৷ রোজ ঠিক সময়ে অফিস গিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র ইত্যাদি পড়েটড়ে কোন একটা বই পড়তে শুরু করতাম৷ এতে লাভ যেটা হল, বেশ কিছু জমে থাকা বই পড়া হয়ে গেল৷ কোনকিছুই তো আর পুরো খারাপ হয় না ---সেটাই আরেকবার অনুভব করলাম আর কি!


শহর বদলানো মানেই এক বড়সড় ঝামেলাপর্ব৷ প্রথম কাজই হল এখানকার বাড়ীতে নোটিশ দেওয়া আর কলকাতায় একটা থাকার জায়গা খুঁজে বের করা৷ এই বাড়ীটা ছাড়তে বেশ কষ্টা হচ্ছে৷ এই বাড়ীতে থাকতে আসা আর সচলায়তনে লেখালেখি শুরু করা সমসাময়িক৷ বাড়ীটা মুম্বাই-ব্যাঙ্গালুরু জাতীয় সড়কের ধারে হওয়ায় আশেপাশে অনেক ফাঁকা জায়গা৷ বড় শোবারঘরের লাগোয়া ব্যালকনিটা ভারী সুন্দর৷ এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা ইজিচেয়ারে বসে বসে আকাশ আর পাহাড় দেখে দেখে কাটিয়ে দিয়েছি৷ এমনিতে পুণের ফ্ল্যাটবাড়ীগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য আছে৷ এখানে দোতলার বারান্দার ছাদ হবে চারতলায়৷ মাঝের তিনতলার ফ্ল্যাটের ঐজায়গাটায় থাকবে একটা জানালা৷ একইভাবে তিনতলার বারান্দা হবে একটু বাঁয়ে বা ডাইনে সরে আর তার ছাদ হবে পাঁচতলায়৷ চারতলার একটা জানলা থাকবে ঐখানে৷ ফলে সমস্ত বারান্দাগুলোতেই আলোহাওয়া খেলে প্রচুর৷ আর বাড়ীগুলো আট কিম্বা ন'তলার বেশী বড়ও হয় না৷ ফলে ঘিঞ্জিভাবটা আসে না৷ এই গঠনটা আমি দিল্লী, গুরগাঁও কিম্বা কলকাতায় দেখিনি৷ আমি থাকি আটতলা বাড়ীর সাততলায়, ফলে আমার ব্যালকনিগুলোর উপরে আর কোন ছাদ নেই৷ বাড়ীওয়ালা অবশ্য চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমার তা একেবারেই পাছন্দ হয় নি বলে মানা করে দিয়েছিলাম৷ পাহাড় তো আর পাব না, কিন্তু অন্তত চারপাশে কিছু গাছপালাওয়ালা জায়গাও যদি কলকাতায় অফিসের কাছাকাছি খুঁজে পাই তো বড় ভাল হয়৷


এই ছাদ থেকেই আমার "ক্লাউড' অ্যালবামের অধিকাংশ ছবিগুলো তোলা৷ একখানা দিলাম এখানে৷


সাজুগুজু করা সুন্দরী মেঘ






--
কদিন ধরে মনে হচ্ছে অনেকদিন শামুক দেখি না৷ আমাদের পাড়াটা ছিল কোন্নগরের গামলা৷ খানিক বৃষ্টি হলেই সারা কোন্নগরের জল এসে জমা হত আমাদের পাড়াটায়৷ ছোটবেলায় জল জমলে ভারী খুশী হতাম৷ ক্লাস সিক্স, সেভেন পর্যন্ত আমাদের আশেপাশে অনেকগুলো পুকুর ছিল৷ ফলে জল জমলে কই বা বাটার ঝাঁক এসে উঠোনের আম, পেয়ারা, শিউলি গাছের পাশ দিয়ে সাঁতরে যেত৷ আর চিত্রবিচিত্র করা শামুকগুলো বারান্দায় উঠে আসত৷ সামান্য সাড়া পেলেই খোলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ত৷ বড়সড় কেঁচো আর লালমেরুণ কেন্নোরাও উঠে আসত৷ আমি আর ভাই তাদের কাঠি দিয়ে ধরে ধরে জলে ফেলে দিতাম৷ দু'চারটে ব্যাঙাচী বা সদ্যলেজখসা কুট্টি কুট্টি ব্যাঙও যে আসত না তা নয়৷


ব্যাঙের কথায় একটা কথা মনে হল৷ অধিকাংশ মানুষের বোধহয় নিজের অগোচরেই কালো বা কালচে রঙের প্রতি একটা অপছন্দের ভাব আছে৷ সেইসব লোকরা আবার সোনালী বা অমন ধরণের রং খুব পছন্দ করে৷ হতে পারে ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন লোকের কথাবার্তা, গল্পগাছার মাধ্যমে ওটাই মাথার মধ্যে গেঁথে যায়৷ সাদা, সোনালী ইত্যাদি ভারী ভাল আর এদিকে কালো, ধূসর, খয়েরী এরা সব ভারী খারাপ৷এই মাস খানেক কি দুয়েক আগে গুরুচন্ডা৯তে এক বন্ধু নেহাত্ই খেলার ছলে একটা গল্প লিখতে শুরু করে৷ এক যুবকের সাথে এক ব্যাঙকুমারীর প্রেম৷ গল্পটা একটু এগোতেই আমি একটা মজার জিনিষ লক্ষ করলাম৷ উত্সাহদাতা পাঠকেরা কেউ কেউ জানতে চাইছেন তারপরে 'সোনাব্যাঙ'টার কী হল? তখনও পর্যন্ত গল্পে কোথায়ও বলা হয় নি 'ব্যাঙ্কুয়ারী' (ওটাই নাম ছিল গল্পে) সোনা না কোলা৷ পাঠকদের আগ্রহেই কিনা জানিনা লেখক দেখলাম আস্তে আস্তে ব্যাঙ্কুয়ারীর নরম সবুজ রঙের কথা বলতে শুরু করলেন৷ সোনাব্যাঙের একটা প্রজাতি গাঢ় সবুজ রঙের হয় বলে জানি৷ আমরা কিরকম নিজেদের অগোচরেই এমনকি ব্যাঙের মধ্যেও 'সোনা'টাকেই পছন্দ করি আর কোলাগুলোকে দূরছাই করি৷ কালোকোলো গুটিওয়ালা কোলাব্যাঙের আর 'মণ্ডুকানুষী' হওয়া হয় না৷ রেসিস্ট বাঙালী ব্যাঙের মধ্যেও কালোগুলোকে হ্যাটা করে৷ আমি অবশ্য আরো বড় রেসিস্ট৷ ব্যাঙ প্রাণীটাকেই পছন্দ করি না; সে সোনা, কোলা, ট্যারা, ব্যাঁকা যাই হোক না কেন৷




সেদিন অফিসে বসে বসে শচীনের বিধ্বংসী ইনিংসটা দেখছিলাম৷ কাজকম্ম ছিল না, তাই ক্যাফেটেরিয়াতেই মৌজ করে বসে দেখলাম৷ তা, সবচেয়ে মজার ব্যপার হল অত চার ছয় মেরেও ধোনির খিস্তি খাওয়া৷ ধোনি একটা করে মারছে আর আশেপাশের ছেলেপুলে 'আব্বে তেরি মায় কি ----' বলে খিস্তাচ্ছে৷ শচীনের স্ট্রাইক নষ্ট হল, এই আশঙ্কায় লোকে ধোনির একেবারে বাপ মা তুলে গালি দিয়ে চলেছে৷ অত চার ছয় মেরেও অত গালি খাওয়াও একটা রেকর্ড বটে৷ আর এখানে মারাঠি অস্মিতার ঠ্যালায় এমনিতেই শচীনের উল্টোদিকে যেই দাঁড়াক তাকেই সন্দেহের চোখে দেখে এরা৷ আর শচীনও এক প্রতিভা বটে৷ এই প্রায় সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ------- অবিশ্বাস্য! খেলা দেখতে দেখতে বারবার সেই হেনরি ওলাঙ্গাকে বলে বলে তুলে মারা মনে পড়ছিল৷ তার আগের ম্যাচেই মুখের কাছে উঠে আসা বলে ব্যাট চালিয়ে আউট হল শচীন আর ফেরার রাস্তায় ওলাঙ্গার দুইহাত তুলে নাচ৷ ব্যাস! পরের ম্যাচে জাস্ট পিষে দিল৷ আমার মস্ত সৌভাগ্য যে গাভাসকার, কপিলদেবের কেরিয়ারের পীক পিরিয়ডটা আর সৌরভ, শচীনদের পুরোটাই দেখতে পেলাম৷


এই মারাঠি অস্মিতার কথায় মনে পড়ল, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চাকরী করার অভিজ্ঞতা ও বন্ধুদের থেকে শুনেটুনে বুঝলাম, মহারাষ্ট্রেই এমনকি কর্পোরেট কোম্পানিগুলোতেও নির্লজ্জভাবে মারাঠি তোষণ করে৷ এখানেই একমাত্র অফিশিয়াল কনফারেন্স কলেও দুমদাম লোকজন মারাঠিতে কথা বলতে শুরু করে দেয়৷ সে যে কি ঝামেলা! বাকি সর্বত্রই একটু রেখেঢেকে হয়৷ এখানে একেবারে খোলাখুলি৷ এদিকে আমার পদবীটা কিঞ্চিত্ মারাঠি ধরণের৷ ফলে অধিকাংশ লোক আমাকে মহারাষ্ট্রের লোক ভেবে নিয়ে সোজা মারাঠিতে কথা বলতে শুরু করে দেয়৷ সাধারণত: আমাকে কেউ হিন্দী বা ইংরিজি ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কিছু বললে আমি সোজা বাংলাতে উত্তর দিই৷ কিন্তু অফিসে সেটা করা একটু চাপের হয়ে যায়৷ এমনিতে মানুষগুলো যে খারাপ তা নয়, তবে ঐ আর কি৷ আর মারাঠিরা স্বভাবত: একটু অলস, ওদিকে বিহারি বা হরিয়ানভিরা খুবই পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু৷ তাই বিভিন্ন পেশায়, বিশেষত: শ্রমনির্ভর পেশায় বিহারি, হরিয়ানভি, পাঞ্জাবীদের চাহিদা বেশী৷ এখন যখন সর্বত্রই চাকরিবাকরিতে টান পড়ছে, তখন শুরু হয়েছে বিহারি-খেদাও ইত্যাদি৷


তবে কর্পোরেটে আঞ্চলিক রাজনীতির চাষবাসটা বেশ দেখার মত ব্যপার৷ মানে নিজের গায়ে আঁচ না লাগলে, সাইড লাইনে দেখার সুযোগ থাকলে বেশ ইন্টারেস্টিং জিনিষপত্র দেখা যায়৷



--
এতখানি প্যাচাল পাড়লাম, যাঁরা ধৈর্য্য ধরে পড়লেন তাঁদের একটা গান শুনিয়ে যাই৷

Get this widget

Track details
eSnips Social DNA

3 comments:

  1. খুব মনোযোগ দিয়ে পুরো প্যাচালাটা পড়লাম। গানটা এক্সদিও শোনা হলো না স্পিকারের বেঈমানিতে। তা থাক।
    তোমার দেখার চোখ কত সুক্ষ! জানা ছিলো না এমন নয়, তবুও।

    ReplyDelete
  2. porar neshay hatre berai-----tai pelam khuje ei blog---neshar moton gilchhi----gilbo:))

    ReplyDelete
  3. tomar lekhay baktobbyo gulo khub spashto,r barnonao nikhuNt...satyi,amio gilchhi...

    ReplyDelete