তারেক নূরুল হাসান'কে আমরা চিনি 'কনফুসিয়াস' নামে৷ কনফুসিয়াসের লেখালিখির সাথে আমার পরিচয় বিভিন্ন বাংলা ফোরাম ও ব্লগে৷ ওঁর লেখার শান্ত সমাহিত ভাবটি আমার বড় পছন্দের, বড় ঈর্ষারও বটে৷ তাই ওঁর প্রথম বই নিয়ে দু'কথা লিখতে বসে আমি হয়ত খুব একটা নিরপেক্ষ মত দিতে পারব না, সেকথা আগেভাগেই মাননীয় পাঠককে জানিয়ে রাখা ভাল৷ তাহলে এরপরেও আপনি এই লেখাটা পড়বেন কেন? পড়বেন পড়বেন৷ কারণ না পড়লে আপনি জানতে পারবেন না টুপটাপ শব্দ কুড়িয়ে কুড়িয়ে তৈরী হয়ে ওঠা এক একটা আস্ত গল্পের খবর৷
'শস্যপর্ব' থেকে প্রকাশিত 'কাঠের সেনাপতি', একটা পাতলামত বই, মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৪৷ মাত্রই ৬টি গল্প আছে৷ গল্পগুলি 'সমান্তরাল', ' বউ', 'কাঠের সেনাপতি', 'ইঁদুর', 'নিমন্ত্রণ' ও 'শব্দশিল্পী'৷ শস্যপর্বের প্রকাশনার মান যথেষ্ট ভাল, ভাল মানের কাগজ ও বাঁধাই, বানানভুল প্রায় নেইই, যে সব বই হাতে নিলেই কিনতে ইচ্ছে করে এটি সেরকম একটি বই৷ নজরুল ইসলামের করা প্রচ্ছদটিও ভারী ভাল৷
'সমান্তরাল' এই সংকলনের শ্রেষ্ঠ গল্প৷ সত্যি বলতে কি আমার পড়া তারেকের যাবতীয় গল্পের মধ্যে এখনও পর্যন্ত এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ৷ খুব শান্ত, প্রায় অলস ভঙ্গীতে শুরু হয় 'সমান্তরাল' গল্পটি৷ বৃষ্টি, কতগুলো মানুষের ভিজতে ভিজতে গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা, বন্ধু, গল্পকথকের মা ইত্যাদি হয়ে চতুর্থভাগে এসে আমরা জানতে পারি গল্পকথকের বাবার অন্তিমকাজের জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন৷ পুড়তে থাকে একটি সিগারেট আর আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে থাকে এক পুত্র ও তার পিতার মধ্যে সম্পর্ক , সম্পর্কের টানাপোড়েন, পিতার প্রতি তার অপরিসীম ঘৃণা, অন্তর্দহন, পিতা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়া, আরও নানান টুকিটাকি, এটাসেটা৷ জীবন বয়ে চলে নিজের ছন্দে, যুবকের অন্তর্দহন ফুরায় না৷ গল্পের শেষটা থমকে দাঁড় করিয়ে দেয়, বারবার পড়িয়ে নেয়, অসাধারণ একটি গল্প৷
'বউ' এক গোবেচারা যুবকের নিজের মত করে ইচ্ছাপূরণের গল্প৷ যুবক মনজুর সব মনে রাখে, স-অ-ব৷ তাই শাহানাকে ভোলা হয় নি, হয়ে ওঠে নি তার জীবনে অন্য কারো আবাহনও৷ তবু রুমা আসে মনজুরের জীবনে৷ গল্পটি শেষ হয় একটি চমক দিয়ে৷ কিন্তু চমকটি তেমন করে চমকে দেয় না, অনেক আগেই সচেতন পাঠকের কাছে চমকটার আভাস ধরা দেয়৷ এই বইতে এটিই সবচেয়ে দুর্বল গল্প বলে মনে হয়েছে আমার৷
'কাঠের সেনাপতি'ও শুরু হয় ঢিমেতালে, পিতাপুত্রের দাবাখেলা, রাশেদ ও তাঁর পিতা দাবা খেলেন, মা দর্শক; আছেন আরও এক দর্শক দেওয়ালের ছবির মধ্য থেকে একদল লোকের সামনে একটা আঙুল উঁচিয়ে৷রাশেদের মুক্তিযোদ্ধা বাবা পুত্রের কবিতা লেখার ক্ষমতায় উচ্ছসিত৷ গল্প এগোয় ধীরেসুস্থে৷ হঠাত্ই ওঁদের দাবাখেলার ছক পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে৷ আর তারেক আবারও অসম্ভব মুন্সিয়ানার সাথে শেষ করেন গল্পটি৷ আবারও বারবার পড়তে হয়৷
'ইঁদুর' গল্পের পটভূমি আর বাংলাদেশ নয়, বিদেশ৷ এক নিরীহদর্শন কিন্তু নৃশংস লোক যে পাঁচটা দোকান ঘুরে পছন্দসই একটা শক্তপোক্ত ইঁদুরমারার কল কেনে এবং ইঁদুরের মৃত্যুযন্ত্রণা তারিয়ে তারিয়ে দেখে৷ একইরকম নিরাসক্তভাবে মেরে ফ্যালে আরও বড় কিছু, যা-ই তার কাছে বিরক্তিকর, বাধাস্বরূপ মনে হয়, তাইই৷ এই নিস্পৃহ নৃশংসতার গল্প উত্তমপুরুষের বয়ানে৷ আর তাতেই গল্পটা এক অদ্ভুত মাত্রা পেয়েছে৷ গল্পটি ডার্ক, বেশ ডার্ক৷ প্রতি মুহুর্ত্তে লোকটিকে ঘৃণা হয়, কিন্তু গল্পটি শেষ পর্যন্ত না পড়ে ওঠা তো দূরের কথা, ডাইনেবাঁয়ে তাকানোও সম্ভব হয় না৷ আক্ষরিক অর্থেই গোগ্রাসে গেলার মত গল্প৷
'নিমন্ত্রণ' ভূতের গল্প৷ উত্তমপুরুষে বলা গল্পটির শেষটিই গোটা গল্পটিকে সাধারণ ভূতের গল্পের কাতার থেকে ধাক্কা মেরে অসাধারণের দিকে এগিয়ে দেয়৷ তবে ভূতের গল্পের ধরণগুলি বহু ব্যবহৃত হওয়ার ফলেই হয়ত এই গল্পটা শেষ পর্যন্ত অসাধারণ না হয়ে একটা 'অন্যরকম ভুতের গল্প' হয়ে থেকে যায়৷
শেষ গল্প 'শব্দশিল্পী'৷ যে বই শুরু হয় 'সমান্তরাল' দিয়ে সেই বই শেষ হওয়ার জন্য 'শব্দশিল্পী' হতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ পছন্দ৷ এটিই বইয়ের দীর্ঘতম গল্পও বটে৷ এক বালক আবৃত্তিকার বয়স বাড়ার পরে দেখেন যে তিনি 'হৃদয়' শব্দটি ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারছেন না৷ হয় তা 'রিদয়' নয়ত 'হিদয়' হয়ে যায়৷ ফলত: তিনি আবৃত্তি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন৷অপরের কন্ঠস্বর, গায়কী, কথন অবিকল অনুকরণের দক্ষতা তাঁকে জুটিয়ে দেয় জীবনধারণের প্রয়োজনীয় রসদ৷ তিনি আকৃষ্ট হন ভেন্ট্রিলোক্যুইজমের দিকে৷ শুরু হয় স্বর প্রক্ষেপণ, বিশেষত: ঠোঁট না নাড়িয়ে সম্ভব অসম্ভব বিভিন্ন স্থান থেকে স্বর প্রক্ষেপণের সাধনা৷ হয়ে ওঠেন 'শব্দশিল্পী'৷ তাঁর এই অর্জিত দক্ষতা তিনি ব্যবহার করেন দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে৷ এই দক্ষতা হয়ে ওঠে এক লড়াইয়ের হাতিয়ার৷ ছোটখাট ডিটেলের টুকটাক বর্ণনা গল্পটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে৷
তারেকের গল্পগুলি অধিকাংশই উত্তমপুরুষে লেখা৷নিটোল এক একটি গল্প পড়তে পড়তে পাঠক প্রতিটি গল্পের মধ্যে ঢুকে যান অতি সহজে, গল্পটা যেন পাঠকের চারপাশেই ঘটছে৷ আর তারপরেই লাগে ধাক্কাটা৷ প্রায় প্রতিটি গল্প ধাক্কা দেয়, ভাবতে বসায়৷ বইটি হয়ে ওঠে একটি সার্থক গল্পসংকলন৷ তারেকের গল্প সম্পর্কে মাহবুব আজাদের সাথে গলা মিলিয়ে বলি তাঁর গল্পে "দৃষ্টি আকর্ষণী উন্মত্ত চিত্কার নেই, আপন ঢোল ভেবে যথেচ্ছ বাদনবিভ্রাট নেই, তাঁর গল্পগুলি যেন সন্ধ্যায় পাঠকের দোরে করাঘাত করে ডাকে, 'বাড়ী আছ?' '
আপনাকেও ডাকছে পাঠক, পড়েই দেখুন না৷
No comments:
Post a Comment