সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কোলে কোলে বেড়ে ওঠা এই শহরটা মাত্র কয় বছর আগেও ছিল ছোট্ট একটা ঘুমুঘুমু শহর৷ ছিমছাম দোতলা চারতলা বাড়ী, শহরের অনেকটা জুড়ে ক্যান্টনমেন্ট, রাস্তার দুদিক থেকে উঠে যাওয়া মস্ত মস্ত গাছের ডাল জুড়ে রাস্তার ওপরে তৈরী আর্চ আর নীচে আলোছায়ার আঁকিবুকি, হঠাৎ হঠাৎ চড়াই উৎরাই হয়ে যাওয়া রাস্তাওয়ালা এই শহরের দোকানদারেরা দুপুরবেলা মফস্বলের মত দোকান বন্ধ করে বাড়ী যেত৷ খেয়ে ঘুমিয়ে এসে আবার দোকান খুলত বিকেলবেলা৷ অমুক তমুক 'মিত্রমণ্ডলী'র ব্যবস্থাপনায় নাটক কিম্বা গানবাজনার অনুষ্ঠানও নিয়মিতই হত৷আর পুণে ইউনিভার্সিটি, ফার্গুসন কলেজ, সিমবায়োসিস কিম্বা ফিল্ম ইনস্টিটুটের ছাত্রছাত্রীদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে থাকে তো আজও, এই ঘটমান বর্তমানেও৷
তারপর বোম্বে যখন মুম্বাই হয়ে গেল, তার খানিক পর থেকেই পুণে শহরটা গায়েগতরে বাড়তে শুরু করে, অনেকটাই তথ্যপ্রযুক্তিশিল্পের হাত ধরে হাঁটি হাঁটি৷ প্রথমে খেলার মাঠ, পার্ক আর আগাছাভরা জমিগুলোতে আটতলা, দশতলা বাড়ী উঠল৷ আস্তে আস্তে সেসব ফাঁকাজমি শেষ হয়ে আসতেই পাহাড় কেটে কেটে ছোট ছোট গাঁও উচ্ছেদ করে করে ঘরবাড়ী, আফিস কাছারি গড়ে উঠল৷ ইনফোসিস, উইপ্রো কিম্বা কগনিজেন্টের বিশাল বিশাল একাধিক কমপ্লেক্স; আর তারই সহায়কহিসাবে একাধিক ছোটখাট টাউনশিপ নিয়ে পুণে এখন রীতিমত 'মেগাসিটি' হওয়ার জন্য দৌড়োচ্ছে৷ তবু এ শহর এখনও শান্তশিষ্টই৷ ২০০৮ এর নভেম্বরে মুম্বাই যখন বোমায় বন্দুকে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, তখনও এ শহর ছিল প্রায় নির্বিকার৷ ভাবটা এমন যেন "ওসব তো বড় শহরের বড় ব্যপার'৷ অথচ পুণে-মুম্বাই নিত্যযাত্রীর সংখ্যা নেহাত্ কম নয়৷ তবু ঐ কর্মক্লান্ত দিনের শেষে মুম্বাই থেকে পুণেতে না ফিরলে হয় না বেশ কয়েক হাজার লোকের৷
গত শনিবার মানে ১৩ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় এই শহরের হোটেল, রেস্তোরাঁ, পাবগুলোতে যখন প্রি-ভ্যালেন্টাইনস পার্টি জমজমিয়ে চলছে, তখন হঠাৎই আমার ছাদে বসে মনে হল রাস্তায় দু চাকা চারচাকার ভীড়টা যেন বড্ডই বেশী৷ আমি থাকি মুম্বাই-ব্যাঙ্গালোর হাইওয়ের পাশটিতে৷ শনিবার রাতে সে রাস্তায় সাধারণত অল্প কিছু ট্রাকের আনাগোনা দেখা যায়৷ ভাবলাম সবই সন্তবাবাজীর জন্য হয়ত বা৷ ঘন্টাখানেকের মধ্যে এক বন্ধুর ফোন, প্রায় চীৎকার করে জিজ্ঞাসা 'কিরে তুই কোথায়???' আমি দারুণ অবাক! এ আবার কেমন প্রশ্ন! কেন বাড়ীতে --- বলতে বলতেই শুনি কোরেগাঁও পার্কে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, ৯ জন মৃত৷ আমার বাড়ীতে টিভি নাই, অগত্যা নেট খুলে বসলাম৷ দেখতে দেখতেই হাইওয়ে দিয়ে প্রবল ভেঁপু বাজিয়ে কটা পুলিশের গাড়ী আর মিলিটারি জিপ দৌড়ে গেল৷ এরপর তো উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ফোনের পর ফোন -- রবিবার বিকেল অবধি চলল৷ বিস্ফোরণ হয়েছে জার্মান বেকারিতে৷ এই কোরেগাঁও পার্ক এলাকাটি পুণের মধ্যে বেশ অভিজাত অঞ্চল৷ সেখানকার সাথে মানানসই এই বেকারি৷ মালিক বছরের অধিকাংশ সময় জার্মানিতে থাকেন৷জার্মান বেকারি তার নামের সাথে মানানসইভাবেই ইউরোপিয়ান সজ্জায় সজ্জিত৷ এদের কিছুকিছু বেকারি আইটেমের স্বাদ সত্যিই উৎকৃষ্ট৷ পারিপার্শ্বিক, সজ্জা ও খাবারের গুণগত মানের জন্য বহুলোকের প্রিয় এটি৷ ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ওশো আশ্রম আর ইহুদিদের শাবাদ (উচ্চারণটা কি ঠিক হল?) ৷ ফলে প্রচুর বিদেশী, বিদেশিনীর আনাগোনাও লেগেই থাকে৷ মোটকথা জার্মান বেকারি যাকে বলে বেশ 'হেপ' জায়গা৷ তো, দেখেশুনেই সেখানে বোমা রাখা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে৷ রবিবার সকালেই খবর পেয়ে যাই আমাদের অফিসের ৫ জন আহত৷ ৩ জনকে ফার্স্ট এইড দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাকী দুজনের আঘাত গুরুতর৷ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত একজন সম্ভবত: তার শ্রবণশক্তি হারাতে চলেছে চিরতরে৷
রবিবার থেকে সর্বত্র লোকের মধ্যে একটা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাব৷ আর যথারীতি নানারকম গুজব একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে ছোটে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশীবার শুনলাম যে এর পরের টার্গেট কলকাতা৷ সোমবার অফিস যাওয়ার সময় রাস্তাঘাটে দেখি একটু অতিরিক্ত সতর্কতা৷ অফিসে তো সাংঘাতিক কড়াকড়ি৷ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে পুণে৷ আর যতই স্বাভাবিক হচ্ছে ততই ক্রমশ: ক্ষেপে উঠছে লোক৷ এমনিতেই পুণেতে বাল (ঠ্যাকারে) ও তার বাচ্চাদের 'মারাঠি অস্মিতা'র প্রকোপ একটু বেশী৷ এইবারে সেটা আরও ফুঁসে উঠেছে৷ বেশ বড় একটা অংশের বক্তব্য হল পাকিস্তানের সাথে যাবতীয় কথাবার্তা বন্ধ করে সোজা ফৌজ পাঠাও৷ সামরিকবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা কাগজে কাগজে বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন ভারতের কেন এবং কীভাবে ইজরায়েলের মত নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন করা উচিত্৷
ইতিমধ্যে জেনে গেছি কলকাতার সল্ট লেক এলাকার দুইভাইবোন আর তাদের বন্ধু ঐ বিশেষ টেবিলে বসেছিল, যার নীচে বিস্ফোরকপূর্ণ ব্যাগটি ছিল৷ তাদের দেহ এতটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে যে তা আর কলকাতায় আনা যায় নি, কোনরকমে কাপড়ে জড়িয়ে পুণেতেই নদীর তীরে নিয়ে পুড়িয়ে দিতে হয়েছে৷ জেনে গেছি সেই অটোরিকশাওয়ালার কথা, যিনি ঐ বেকারির সামনে দিয়ে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, বিস্ফোরণের ধাক্কায় চলন্ত অটোরিকশা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়েন, মাথায় গুরুতর আঘাত লাগায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যান৷ জেনে গেছি পুণে অ্যামডকসের সেই প্রোগ্রামার মেয়েটির কথা, যার আসলে মুম্বাইতে বাড়ী, সপ্তাহান্তে সেখানেই ফিরেছিল সে; কিন্তু বন্ধুদের অনুরোধে তাদের পার্টিতে যোগদানের জন্য শনিবারেই আবার চলে আসে এবং প্রাণ হারায়৷ জেনে গেছি সেই ওয়েটারটির কথা, যে ব্যাগটিকে টেনে বের করতে গিয়ে প্রাণ হারায়৷ এরা সবাই যখন ওখানে ঢুকেছিল, বসেছিল বা সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখনই সেই ঘড়িটা চলতে শুরু করেছি, টিক টক --- টিক টক --- টিক টক৷ এবার সুরক্ষাচক্র আরও আঁটোসাঁটো হয়ে উঠবে, মলিন পোশাকপরা অতিথি দেখলেই দরজার সুরক্ষাকর্মীর চোখ চকচকে হয়ে উঠবে শিকার ধরার আনন্দে৷ কাশ্মিরী শালওয়ালা কিম্বা ইরানী ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই ভুঁরু কুঁচকে উঠবে অনেকের৷ বেড়ে যাবে মেটাল ডিটেক্টারের বিক্রী ও ব্যবহার৷ হয়তবা, হয়তবা বাড়বে আরও কিছু চাকরীর সুযোগ, বিভিন্ন স্তরের সুরক্ষাকর্মী পদের জন্য৷
কিন্তু এতকিছু করেও কি আমরা নিরাপদে বেঁচেবর্তে থাকতে পারব? কিরকম যেন মনে হচ্ছে কোথায়ও একটা ঘড়ি চালু হয়ে গেছে 'টিক টক ---- টিক টক ----- টিক টক'৷ শুধু বিস্ফোরণের মুহূর্তটির অপেক্ষা৷ হতে পারে তা কালকেই অফিসে কিম্বা কফিশপে, হতে পারে আগামী সপ্তাহে হাওড়া স্টেশানের ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, হতে পারে আগামী মাসে সল্ট লেকের কাফিলায় বন্ধুর যে নেমন্তন্নটা আছে সেইখানে, কিম্বা অন্য কোথায়ও৷ দুদিন ধরে অফিস ব্লগে অনবরত তর্ক করে করে ক্লান্ত আমি, জানি না আর কতদিন এতটা জোরের সাথে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অহেতুক সন্দেহের বিরুদ্ধে, গড়পড়তা সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে তর্ক করে যেতে পারব৷ কে জানে হয়ত আর একটা বিস্ফোরণের অপেক্ষা --- তারপরই আমিও আঙুল তুলে ধরব প্রতিটা অচেনা লোকের দিকে৷
এই আশঙ্কাটাই নিজে বা নিজের কাছের কোন আত্মীয়বন্ধুর ছিন্নভিন্ন হওয়ার আশঙ্কার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে আজ৷ নিজেকেই বারবার বিড়বিড় করে শোনাচ্ছি 'আত্মদীপো ভব আত্মশরণো ভব'
তারপর বোম্বে যখন মুম্বাই হয়ে গেল, তার খানিক পর থেকেই পুণে শহরটা গায়েগতরে বাড়তে শুরু করে, অনেকটাই তথ্যপ্রযুক্তিশিল্পের হাত ধরে হাঁটি হাঁটি৷ প্রথমে খেলার মাঠ, পার্ক আর আগাছাভরা জমিগুলোতে আটতলা, দশতলা বাড়ী উঠল৷ আস্তে আস্তে সেসব ফাঁকাজমি শেষ হয়ে আসতেই পাহাড় কেটে কেটে ছোট ছোট গাঁও উচ্ছেদ করে করে ঘরবাড়ী, আফিস কাছারি গড়ে উঠল৷ ইনফোসিস, উইপ্রো কিম্বা কগনিজেন্টের বিশাল বিশাল একাধিক কমপ্লেক্স; আর তারই সহায়কহিসাবে একাধিক ছোটখাট টাউনশিপ নিয়ে পুণে এখন রীতিমত 'মেগাসিটি' হওয়ার জন্য দৌড়োচ্ছে৷ তবু এ শহর এখনও শান্তশিষ্টই৷ ২০০৮ এর নভেম্বরে মুম্বাই যখন বোমায় বন্দুকে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, তখনও এ শহর ছিল প্রায় নির্বিকার৷ ভাবটা এমন যেন "ওসব তো বড় শহরের বড় ব্যপার'৷ অথচ পুণে-মুম্বাই নিত্যযাত্রীর সংখ্যা নেহাত্ কম নয়৷ তবু ঐ কর্মক্লান্ত দিনের শেষে মুম্বাই থেকে পুণেতে না ফিরলে হয় না বেশ কয়েক হাজার লোকের৷
গত শনিবার মানে ১৩ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় এই শহরের হোটেল, রেস্তোরাঁ, পাবগুলোতে যখন প্রি-ভ্যালেন্টাইনস পার্টি জমজমিয়ে চলছে, তখন হঠাৎই আমার ছাদে বসে মনে হল রাস্তায় দু চাকা চারচাকার ভীড়টা যেন বড্ডই বেশী৷ আমি থাকি মুম্বাই-ব্যাঙ্গালোর হাইওয়ের পাশটিতে৷ শনিবার রাতে সে রাস্তায় সাধারণত অল্প কিছু ট্রাকের আনাগোনা দেখা যায়৷ ভাবলাম সবই সন্তবাবাজীর জন্য হয়ত বা৷ ঘন্টাখানেকের মধ্যে এক বন্ধুর ফোন, প্রায় চীৎকার করে জিজ্ঞাসা 'কিরে তুই কোথায়???' আমি দারুণ অবাক! এ আবার কেমন প্রশ্ন! কেন বাড়ীতে --- বলতে বলতেই শুনি কোরেগাঁও পার্কে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, ৯ জন মৃত৷ আমার বাড়ীতে টিভি নাই, অগত্যা নেট খুলে বসলাম৷ দেখতে দেখতেই হাইওয়ে দিয়ে প্রবল ভেঁপু বাজিয়ে কটা পুলিশের গাড়ী আর মিলিটারি জিপ দৌড়ে গেল৷ এরপর তো উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ফোনের পর ফোন -- রবিবার বিকেল অবধি চলল৷ বিস্ফোরণ হয়েছে জার্মান বেকারিতে৷ এই কোরেগাঁও পার্ক এলাকাটি পুণের মধ্যে বেশ অভিজাত অঞ্চল৷ সেখানকার সাথে মানানসই এই বেকারি৷ মালিক বছরের অধিকাংশ সময় জার্মানিতে থাকেন৷জার্মান বেকারি তার নামের সাথে মানানসইভাবেই ইউরোপিয়ান সজ্জায় সজ্জিত৷ এদের কিছুকিছু বেকারি আইটেমের স্বাদ সত্যিই উৎকৃষ্ট৷ পারিপার্শ্বিক, সজ্জা ও খাবারের গুণগত মানের জন্য বহুলোকের প্রিয় এটি৷ ঢিলছোঁড়া দূরত্বে ওশো আশ্রম আর ইহুদিদের শাবাদ (উচ্চারণটা কি ঠিক হল?) ৷ ফলে প্রচুর বিদেশী, বিদেশিনীর আনাগোনাও লেগেই থাকে৷ মোটকথা জার্মান বেকারি যাকে বলে বেশ 'হেপ' জায়গা৷ তো, দেখেশুনেই সেখানে বোমা রাখা হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে৷ রবিবার সকালেই খবর পেয়ে যাই আমাদের অফিসের ৫ জন আহত৷ ৩ জনকে ফার্স্ট এইড দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাকী দুজনের আঘাত গুরুতর৷ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত একজন সম্ভবত: তার শ্রবণশক্তি হারাতে চলেছে চিরতরে৷
রবিবার থেকে সর্বত্র লোকের মধ্যে একটা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাব৷ আর যথারীতি নানারকম গুজব একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে ছোটে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশীবার শুনলাম যে এর পরের টার্গেট কলকাতা৷ সোমবার অফিস যাওয়ার সময় রাস্তাঘাটে দেখি একটু অতিরিক্ত সতর্কতা৷ অফিসে তো সাংঘাতিক কড়াকড়ি৷ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে পুণে৷ আর যতই স্বাভাবিক হচ্ছে ততই ক্রমশ: ক্ষেপে উঠছে লোক৷ এমনিতেই পুণেতে বাল (ঠ্যাকারে) ও তার বাচ্চাদের 'মারাঠি অস্মিতা'র প্রকোপ একটু বেশী৷ এইবারে সেটা আরও ফুঁসে উঠেছে৷ বেশ বড় একটা অংশের বক্তব্য হল পাকিস্তানের সাথে যাবতীয় কথাবার্তা বন্ধ করে সোজা ফৌজ পাঠাও৷ সামরিকবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা কাগজে কাগজে বিবৃতি দিয়ে জানাচ্ছেন ভারতের কেন এবং কীভাবে ইজরায়েলের মত নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন করা উচিত্৷
ইতিমধ্যে জেনে গেছি কলকাতার সল্ট লেক এলাকার দুইভাইবোন আর তাদের বন্ধু ঐ বিশেষ টেবিলে বসেছিল, যার নীচে বিস্ফোরকপূর্ণ ব্যাগটি ছিল৷ তাদের দেহ এতটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে যে তা আর কলকাতায় আনা যায় নি, কোনরকমে কাপড়ে জড়িয়ে পুণেতেই নদীর তীরে নিয়ে পুড়িয়ে দিতে হয়েছে৷ জেনে গেছি সেই অটোরিকশাওয়ালার কথা, যিনি ঐ বেকারির সামনে দিয়ে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, বিস্ফোরণের ধাক্কায় চলন্ত অটোরিকশা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়েন, মাথায় গুরুতর আঘাত লাগায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যান৷ জেনে গেছি পুণে অ্যামডকসের সেই প্রোগ্রামার মেয়েটির কথা, যার আসলে মুম্বাইতে বাড়ী, সপ্তাহান্তে সেখানেই ফিরেছিল সে; কিন্তু বন্ধুদের অনুরোধে তাদের পার্টিতে যোগদানের জন্য শনিবারেই আবার চলে আসে এবং প্রাণ হারায়৷ জেনে গেছি সেই ওয়েটারটির কথা, যে ব্যাগটিকে টেনে বের করতে গিয়ে প্রাণ হারায়৷ এরা সবাই যখন ওখানে ঢুকেছিল, বসেছিল বা সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখনই সেই ঘড়িটা চলতে শুরু করেছি, টিক টক --- টিক টক --- টিক টক৷ এবার সুরক্ষাচক্র আরও আঁটোসাঁটো হয়ে উঠবে, মলিন পোশাকপরা অতিথি দেখলেই দরজার সুরক্ষাকর্মীর চোখ চকচকে হয়ে উঠবে শিকার ধরার আনন্দে৷ কাশ্মিরী শালওয়ালা কিম্বা ইরানী ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই ভুঁরু কুঁচকে উঠবে অনেকের৷ বেড়ে যাবে মেটাল ডিটেক্টারের বিক্রী ও ব্যবহার৷ হয়তবা, হয়তবা বাড়বে আরও কিছু চাকরীর সুযোগ, বিভিন্ন স্তরের সুরক্ষাকর্মী পদের জন্য৷
কিন্তু এতকিছু করেও কি আমরা নিরাপদে বেঁচেবর্তে থাকতে পারব? কিরকম যেন মনে হচ্ছে কোথায়ও একটা ঘড়ি চালু হয়ে গেছে 'টিক টক ---- টিক টক ----- টিক টক'৷ শুধু বিস্ফোরণের মুহূর্তটির অপেক্ষা৷ হতে পারে তা কালকেই অফিসে কিম্বা কফিশপে, হতে পারে আগামী সপ্তাহে হাওড়া স্টেশানের ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, হতে পারে আগামী মাসে সল্ট লেকের কাফিলায় বন্ধুর যে নেমন্তন্নটা আছে সেইখানে, কিম্বা অন্য কোথায়ও৷ দুদিন ধরে অফিস ব্লগে অনবরত তর্ক করে করে ক্লান্ত আমি, জানি না আর কতদিন এতটা জোরের সাথে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অহেতুক সন্দেহের বিরুদ্ধে, গড়পড়তা সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে তর্ক করে যেতে পারব৷ কে জানে হয়ত আর একটা বিস্ফোরণের অপেক্ষা --- তারপরই আমিও আঙুল তুলে ধরব প্রতিটা অচেনা লোকের দিকে৷
এই আশঙ্কাটাই নিজে বা নিজের কাছের কোন আত্মীয়বন্ধুর ছিন্নভিন্ন হওয়ার আশঙ্কার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে আজ৷ নিজেকেই বারবার বিড়বিড় করে শোনাচ্ছি 'আত্মদীপো ভব আত্মশরণো ভব'
এই ধরনের প্রতিটা ঘটনার পর এই ভয়টা আমার মধ্যেও মাথাচাড়া দেয়। নিজের সাথেই যুদ্ধ চলে। তারপর একটা সময় ছিন্নবিচ্ছিন্ন রেস্তোঁরাকে ভুলে মনে রেখে দিই শুধু কেক, পেস্ট্রী, লাল বেলুন আর সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। নির্বোধ না হতে পারলে বোধ হয় পাগল হয়ে যেতে হয়!
ReplyDeleteশিল্পা গোয়েঙ্কা, যে মেয়েটি মারা গেছে, মিষ্টির বন্ধুর ছোটো বোন।
ReplyDeleteআমার চেনা , তোমার চেনা, তার চেনা ---- এমনিভাবেই কারো না কারো চেনা লোকগুলো কিচ্ছু না জেনে, না করেও ছিন্নভিন্ন হচ্ছে৷
ReplyDelete