খোঁজাখুঁজি

Wednesday, February 3, 2010

আইন যখন তামাশা

অরিন্দম দাশগুপ্ত(অনুবাদক); মিয়াজান দারোগার একরারনামা ; প্রকাশক (কলকাতা :চর্চাপদ); পৃষ্ঠাসংখ্যা 152(পরিশিষ্টসহ)
ISBN : 978-81-907607-5-1


বেঙ্গল লাইব্রেরী ক্যাটালগ থেকে প্রাপ্ত মূল পুস্তক সম্পর্কে তথ্যাদি:
F F Christian - The Confession of Miajan, Daroga of Police dictated by him and translated by a Muffussilite ; Publisher - Messers Wyman and Company, 1A Hare Street Calcutta; Date of Publication - 10.4.1869; Pages - 148; No. of copies - 200


সে এক সময়, ইংরেজ তখনও ভারতবর্ষের শাসনভার নিজের হাতে সম্পূর্ণ তুলে নেয় নি, খাতায়কলমে মুঘলসম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর তখনও দিল্লীর মসনদে , সিপাহী বিদ্রোহের তখনও সতেরো আঠেরো বছর দেরী আছে৷ "আইনের শাসন' নিতান্তই কাগজে কলমে অবস্থিত, বাস্তবে খুব একটা দেখা যায় না; সে এক সময় যখন আস্তে আস্তে নীলকররা জাঁকিয়ে বসছে, জমিদাররা লুঠতরাজকে মোটামুটি ধর্ম বলেই মনে করেন৷ সে এক সময় যখন সতীদাহ প্রথা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও টুকটাক এদিকওদিক সতী হওয়ার গল্প শোনা যায়; রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনও তৈরি করে উঠতে পারে নি ইংরেজরা৷ সেই সময়ের নানান কাহিনী, সত্য ও কাল্পনিক দুই-ই আমরা পড়েছি৷ পড়েছি আইন ও বিচারবিভাগ এব ংপুলিশি হালচাল নিয়েও কিছু বইপś৷ অনেকের ম্তে, বিশেষত: ঔপনিবেশিক কালে, 'দারোগাসাহিত্য' কে সাহিত্যের একটা উপবিভাগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়৷


দারোগাসাহিত্যের যে নমুনাটি সম্প্রতি হাতে এলো তাকে নিয়েই এই আলোচনা৷ বইটির নাম মিয়াজান দারোগার একরারনামা ৷ বইটি আঅতপরিচয় লেখকের বয়ানে ইংরাজিতে প্রথম প্রকাশিত হয় 1869 সালে৷ ঘটনাকাল আরও তিরিশ বছর আগের, অর্থাত্ কিনা 1839 এর আশেপাশে৷ বইটি 2009 এর জুনমাসে শ্রী অরিন্দম দাশগুপ্তর অনুবাদে "চর্চাপদ' প্রকাশনী থেকে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে৷

অশিক্ষিত মিয়াজান সম্পূর্ণ নিস্পৃহভাবে বর্ণনা দিয়ে গেছেন তাঁর দারোগাপদ প্রাপ্তি ও স্বল্পকালীন দারোগগিরি, দারোগাপদ লোপ ও পদচ্যুত হওয়ার প্রতিশোধ গ্রহণের গল্প৷ শুরুতেই অকুন্ঠচিত্তে তিনি জানান যে তাঁর বোন হলেন কালেক্টার সাহেবের রক্ষিতা৷ তাই 'জামাইবাবু'র সুপারিশে মাś বিশবছর বয়সে অশিক্ষিত মিয়াজান হয়ে যান পুলিশের দারোগা৷ তাই বলে ভাববেন না যেন মুরুব্বির সুপারিশই দারোগার চাকরির একমাś শর্ত৷ না তা নয়, মিয়াজান আরও জানান যে কালেক্টারের সুপারিশপśরে সাথেই ম্যাজিস্ট্রেটের খাসবেয়ারা গোপালের সাথেও রফা করতে হয়৷ মিয়াজানের দস্তখত্ করা রসিদে মিয়াজানের মাসমাইনেটি প্রতিমাসে তুলবেন ম্যাজিস্ট্রেটের খাসবেয়ারা৷ এছাড়াও তিনি আরও একশো টাকাও পান৷ পাঠক অবাক হয়ে ভাবতে পারেন তাহলে মিয়াজানের সংসার চলবে কি করে, যদি মাসমাইনে সর্বদা গোপালই পান! উত্তর খুব সহজ, দারোগার রোজগার অন্যś, বিভিন্ন মামলার বাদী কিম্বা বিবাদী অথবা দুজনের কাছ থেকেই ঘুষ নেওয়া, কোনও জমিদার অথবা প্রভাবশালী লোকের নির্দিষ্ট কোন স্বার্থসিদ্ধির উźশ্যে কাউকে কোনও অভিযোগে গ্রেপ্তার করানো/ মামলায় ফাঁসানো ও তজ্জনিত ঘুষ ইত্যাদিই দারোগার মুল আয়৷ আর ম্যাজিস্ট্রেটের খাসবেয়ারাও কিছু বিনাকারণে দারোগার মাসমাইনে নিয়ে নিচ্ছেন না, এতদ্বারা তিনি দারোগাকে বিভিন্ন বিপদোপদে রক্ষাও করে থাকেন৷ যথা, দারোগার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও মামলা যদি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে যায়, খাসবেয়ারা সেটা ডিস্মিস্ করিয়ে দেন৷ সেইসময় "ঘুষ' অথবা "রিশবত্' যে কি পরম ক্ষমতাধর ও সর্বব্যাপী চালিকাশক্তি ছিল তার প্রমাণ আছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়৷ মিয়াজানের ভাষ্যে আমরা জানতে পারি বিচারক থেকে শুরু করে আমলা, মোক্তার, বেয়ারা, সর্বোছ থেকে সর্বনিম্ন পদের পুলিশকর্মচারি , সকলেই ঘুষখোর৷ মজার ব্যপার হল 1869 সালে এই বইটি প্রকাশিত হলে সমসাময়িক ক্যালকাটা রিভিউ বা হিন্দু পেট্রিয়টের আলোচকগণও ব্যপারটা প্রায় মেনেই নিয়েছেন৷ তাঁদের বক্তব্য, ঘটনাগুলির কিছু সত্যতা থাকলেও ঘটনাকাল আরও তিরিশ বছর আগের৷ তাঁদের দাবি, এই তিরিশবছরে নাকি, ইংরেজের সুশাসনে অবস্থার আসমান জমিন ফারাক হয়ে গেছে! সত্যিই হয়েছিল কিনা, সে অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন৷


বইটির আর একটি জিনিস নজর টানার মত, তা হল পুলিশহাজতে অত্যাচারের বিবরণ৷ মিয়াজান নির্বিকারভাবে বিভিন্ন অত্যাচারপদ্ধতি বর্ণনা করে গেছেন, যা তাঁরা ব্যবহার করতেন সাক্ষীদের কবুল করানোর জন্য৷ মাś একটি এখানে উল্লেখ করছি৷ বাংলাদেশে ঘুরঘুরে পোকা নামে একরকম পোকা আছে, যাদের মুখের দুপাশে চোয়ালের ধারালো অংশ দাঁড়ার মত বেরিয়ে থাকে৷ এই পোকাকে দিনেরবেলা বের করলে এরা নিমেষের মধ্যে পাথুরে জমিতেও ধারালো দাঁড়ার সাহায্যে অত্যন্ত গভীর গর্ত খুঁড়ে ফেলে৷ বেয়াড়া সাক্ষী কিম্বা অপরাধীকে শায়েস্তা করতে তার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে চিত্ করে শুইয়ে গায়ের  বস্ত্র সরিয়ে নাভির ওপর একটা ঘুরঘুরে পোকা রেখে আধখানা শুকনো নারকোল মালা দিয়ে চাপা দিয়ে দেওয়া হত৷ ঘুরঘুরে পোকা তত্ক্ষণাত্ মাটির বদলে নাভিতে গর্ত খুঁড়তে শুরু করত৷ অত্যাচারের বীভত্সতা যে তাঁকে আদৌ স্পর্শ করে নি, তা দেখে অবাক হতে হয়৷ অত্যাচারের সাফাই হিসাবে মিয়াজান যে সব যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন তার প্রতিধ্বনি তো আজও পুলিস হেফাজতে থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগের সাফাই হিসাবে শুনতে পাই৷ অবশ্য মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্টের কথা মনে রাখলে সেটা খুব অস্বাভাবিকও নয়৷


বইটিতে আরও আছে বিবিধপ্রকার জালিয়াতির বিবরণ৷ বইটির সমস্ত ঘটনাই হয়ত সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা নয়৷ তবে মোটের ওপরে এরকম ঘটনা সেসময় খুব দূর্লভও নয়, বর ংপুলিশ-প্রশাসন-সমাজের এক বিশ্বস্ত ছবি, তত্কালীন সময়ের এক চমত্কার কিস্সা বলা যায়৷ যাঁরা ś²আইম থিল্রার পড়তে ভালবাসেন, তাঁরাও বতি হবেন না৷ হার্ডবাউন্ড বইটির প্রচ্ছদ চমত্কার, ভাল মানের কাগজের ব্যবহার চোখকে আরাম দেয়৷ পরিশিষ্টে হিন্দু পেট্রিয়ট ও ক্যালকাটা রিভিউতে প্রকাশিত রিভিউ দুটির অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্য৷

No comments:

Post a Comment