খোঁজাখুঁজি

Tuesday, January 5, 2010

চিত্র-লেখা ১

সারাদিন রেললাইনটা পড়ে পড়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয় আর মাঝরাত্তিরের পর গা মোড়ামুড়ি দিয়ে জেগে ওঠে৷ তখন ওতে কান পাতলে শোনা যায় শোঁ শোঁ, সাঁই সাঁই, ঠুকঠাক, ঢকাং ঢকাং শব্দ৷ তারপর ঝমঝম ঝমাঝম করে একটা বড়সড় জোয়ানমত ট্রেনগাড়ী দৌড়ে যায়৷ আবার চুঁইচুঁই, ঘটাংঘটাং এরপরে ছ:-ঘিসস, ছ:-ঘিসস করে হাঁপের টান টেনে টেনে একটা বুড়োমত মালগাড়ী যায়৷তারপরও রেললাইনটা জেগেই থাকে, যদিও আর গাড়ীটাড়ি আসবে না সেই কাল রাত্তিরের আগে; তবু ও জেগে জেগে অপেক্ষা করে সকালের পাখীগুলোর৷




                                    ছবি সৌজন্য: দ্বৈপায়ন বসু


আকাশে চালধোয়া জলের রং ধরলেই কিচিমিচি করে নেমে আসে ছোটবড় পঞ্ছিগুলো, লাইনের ফাঁক থেকে খুঁটে খুঁটে কিসব খায়, থেকেথেকে উড়ে যায় ঐ নীলচেমত পাহাড়টার দিকে৷ ওরা দৌড়ে উড়ে ছোটবড় গাছগুলোতে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই সুজ্জিমামা এসে পড়ে৷ সুজ্জিমামা যত পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকে পাখীগুলো কোথায় কোথায় যেন চলে যায়৷ দলবেঁধে আসতে থাকে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল৷ কারো পিঠে ব্যাগ, কারো কাঁখে ছোট ঘড়া, কারো হাতে বালতি, কারো হাতে মলাটছাড়া একলাফোকলা কটা বইখাতা৷ আরও আসে কজন শক্তপোক্ত মেয়েমদ্দ৷ কেউ যায় ঐইইইই সামনে পাহাড়গুলোর দিকে, কেউ নামে নীচে নদীর দিকে৷ এইবারে রেললাইনের চোখ জুড়ে আসে ঘুমে৷ পাহাড় টপকে সুজ্জিমামা যখন ঐপারে চলে যায়, তখন সব একেএকে ফিরতে থাকে৷ যে গেছিল বাঁয়ে, সে ফেরে ডাইনে, যে ওপরে গেছিল, নেমে আসে, যে নীচে গেছিল উঠে আসে৷ রেললাইনটা চুপটি করে ঘুমায় আর রোদ পোয়ায় --- বৃষ্টি মাখে ----- কুয়াশা জড়ায়৷ তারপর পাখীপক্ষীগুলো সব গাছে গাছে ওড়াউড়ি ক'রে এরতার সারাদিনের খবর নেয় ---- আকাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসে৷ সুজ্জিমামা অন্যমনস্কভাবে কখন যেন একেবারে দিনের কার্নিশে চলে গেছিল --- পা বাড়াতেই টুপ্পুস করে পেছনের খাদে গড়িয়ে গেল৷ আর অমনি দেখো কতরকমের পোকামাকড় জেগে উঠতে থাকে৷


ওর সৌন্দর্য্য আর বুদ্ধি যতটা কম, স্বাস্থ্য ঠিক ততটাই বেশী৷ এই নিয়ে তো ঘরে বাইরে গঞ্জনার আর শেষ নেই৷ রোজই হয় কয়েকচোট৷ কখনও সখনও চড়থাপ্পড়ও বাদ যায় না৷ এসবে ওর কিছু হয় না৷ অন্তত কেউ কখনও ওকে মনখারাপ করতে দেখেনি৷আজ রাতে যখন ওর ঘুমটা ভাঙল, তখন ও বুঝতেই পারল না কেন ভেঙেছে ঘুম৷ বাপ মা বলে ওর নাকি মড়ার মত ঘুম, একবার পড়ল তো একেবারে সকাল হলে উঠবে৷ তা ঘুম তো একরকম মরেই যাওয়া, অল্প ক'ঘন্টার মরণ --- সেরকমই মনে হয় ওর৷ ও অবাক হয়েই আস্তে আস্তে উঠে বসে, পা বাড়িয়ে নামে খাট থেকে৷ খালিপা মেঝেতে রাখতেই ঠান্ডা মেঝে যেন ছ্যাঁক করে লাগে পায়ের পাতায়৷ পায়ের তলায় ঐ ছ্যাঁকছ্যাঁকানি পাড়িয়ে পাড়িয়ে দরজা খুলে খালিপায়ে বেরিয়ে আসে সামনের উঠোনে৷ কিরকম রুপোলী সাদা চারিদিক --- জ্যোসনায় ভেসে যাচ্ছে উঠোন, গাছপালা, সামনের সরু রাস্তাটা৷ খুব আস্তে প্রায় ফিসফিস করে গাছের ডালপাতাগুলো কিসব পরামর্শ করে চলেছে, ওকে দেখেই সামনেরগুলো চুপ করে গেল৷ একটু ভাল করে শোনার জন্য ও এগিয়ে গেল, ডালপালাগুলোও চুপ হয়ে গেল৷ ও এগোতে লাগল --- পায়ে পায়ে গেট পেরিয়ে রাস্তায ---- দুদিকের বড় গাছের ডাল বেঁকেচুরে রাস্তার ওপরে কেমন আর্চ বানিয়েছে --- ফাঁকেফাঁকে জালিকাটা রুপোলী জোসনা ---- রাস্তা বেয়ে এগিয়ে যায় --- ও-ও এগোয় পায়ে পায়ে আর অমনি গাছেদের ফিসফিসানি থেমে যায় --- বুনোলতা পা টেনে ধরে --- ও কেমন ঘোরের মধ্যে লতা ছিঁড়ে ফেলে এগোয় --- ঝোপঝাড়েরা ফিসফিস করে বলে "শোনো একটু --- শুনে যাও এদিকে' --- ও পা চালায় ----- রেললাইনটা আড়মোড়া ভাঙে ---- ঘুম ভাঙছে ------ গাছপালা ঝোপঝাড় শেষ হয়ে এবড়ো খেবড়ো পাথরে পা পড়ে --- অল্প শিউরে ওঠে কি? চাঁদ আরও মায়াবী হয়ে জোসনা ঢেলে দেয় ---- ও উঠে আসে রেললাইনের ওপরে ----- চাঁদের দিকে মুখ তুলে তাকায় ------- স্নিগ্ধচোখে তাকায় চাঁদ ----- ঝমাঝম ঝমাঝম দৌড়ে আসছে জোয়ান রেলগাড়ীটা ---- তীক্ষ্ণ হুইসিল একবার বেজে ওঠে --- ও শোনে কিনা বোঝা যায় না ---- নড়ে না, চাঁদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে৷

রেলগাড়ী চলে গেলে রেললাইনটা চেটেপুটে খায়, অনেকদিন বাদে ভরপেট খাবার পেয়েছে লাইনটা --- আকাশ পরম আদরে কুয়াশা ঝরায় ------- ঢেকে দেয় ওর টুটাফুটা টুকরোগুলো ---- একটা প্যাঁচা কাকে যেন খবর দিতে, সামনের পাহাড়টার দিকে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় -- ক্র্যাঙঙঙঙ

No comments:

Post a Comment