খোঁজাখুঁজি

Saturday, May 15, 2010

চিত্র-লেখা ২

আজকে সামনের বারান্দায় কেউ আসে নি, বোধহয় বাড়িতে কেউ নেই৷ ওই বাড়িটা আসলে পর্যটকদের থাকার জন্য৷ এই অদ্ভুত নির্জন জায়গাটায়ও কিছু পর্যটক আসে মাঝেমধ্যেই৷ আর আজকাল বোধহয় নির্জন জায়গায় বেড়াতে যাওয়াটা একটা ফ্যাশানও হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বাড়িটা দেখাশোনা করে বাহাদুর আর ওর বউ৷ ওর বউয়ের নাম জানা যায় না৷ ওরা বাড়িটার ওইপাশে একটা আলাদা কোয়ার্টারে থাকে৷



আজ আড়াইবছর হল এখানে এসেছি, এখনও জায়গাটা তেমন নতুনমত রয়ে গেছে৷ বড় মায়াবী জায়গা, সবুজ, গাঢ় গহীন সবুজের প্রলেপ দিয়ে দিয়ে ভুলিয়ে দেয় সব ঠিকভুল হিসেব, ছোটখাট কাটাছেঁড়া, বড়সড় ক্ষত৷ কি বর্ষা, কি শীত সবুজের কোনও কমতি নেই আশেপাশে৷ আর সে যে কতরকমের সবুজ! কোন থানকাপড়ের দোকানেও অতগুলো সবুজের শেড দেখা যায় না৷ এসেছিলাম কয়েকটা জায়গা দেখে একটা বেছে নিতে, যেখান থেকে আর ফিরব না৷ তা এই জায়গাটাই একবারে পছন্দ হল, আর কোথায়ও দেখতেই গেলাম না৷

আছি তো আছি ভালই, বছরে একবার বাড়ি যাই, চেনাশোনা লোকজনের সাথে দেখা সাক্ষাত্ করে, কিছু বইপত্র কিনে ফিরে আসি৷ এখানকার ঠিকানা কেউ জানে না, তাই কেউ আসেও না৷ সৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিষ তো মঙ্গলবারের হাট থেকেই পাওয়া যায়৷ নামে হাট হলেও বাজারটায় বেশ শহুরে জিনিষপত্র পাওয়া যায়৷ টিভি একটা আছে বটে৷ কখনও চালাই, অনেকসময়ই চালাই না৷ ইন্টারনেটটা অবশ্য নিয়মিতই ব্যবহার করি৷ মানে যতক্ষণ সংযোগ থাকে আর কি! মুঠোফোনও আছে একখান৷ যতক্ষণ ইচ্ছে হয় ধরি, কথা বলি৷ নাহলে বন্ধ করে রেখে দিই৷ দিব্বি আছি বলাই যায়৷

********************************************

ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর থেকে শরীর বেশ চনমনে হয়ে গেছে৷ এমনিতে কদিন ধরে খুব হাঁপ ধরছিল, আর মাঝেমধ্যে মাথাটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল৷ একদিন বাহাদুরের বউ এসেছিল সরষের তেল নিতে, ওকে দেখে চিনতেই পারলাম না কয়েক সেকেন্ড৷ তা সে তেমন সমস্যা নয়৷ কিন্তু হাঁপ ধরাটা তেমন সুবিধের নয়৷ সকাল সন্ধ্যেয় টইটই করে বেড়ানো তো হচ্ছিলই না, বাড়ির কাজগুলো করতেও পেরে উঠছিলাম না৷ বাহাদুর আর ওর বউ অনেকবার বলেছে বাড়ির কাজকর্ম করে দেবে৷ বারবার মানা করতে দেখে শেষে ক্ষান্ত দিয়েছে৷ বোধহয় ভেবেছে খুব কিপটে৷
এখানকার ডাক্তার দেখেটেখে খুব গম্ভীর হয়ে শহরে যেতে বলল৷ নাকি আমার ওজন এত বেড়েছে যে স্রেফ সেইজন্যই দুমদাম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যেতে পারে৷ আমাদের ছোটবেলায় এটাকে হার্ট অ্যাটাক বলত বোধহয়৷ নাকি সেটা অন্য রোগ? কে জানে! কিন্তু শহরে গেলে ওজন কমবে কী করে? সেসব কিছু বলে না ডাক্তার, শুধু আরও গম্ভীর হয়ে বলে 'আপনার বি এম আই ৩৫৷ ক্যান য়্যু ইম্যাজিন?' আরে কি মুশকিল! কল্পনা করতে হবে কেন, আমি তো জানিই ৩৫৷ নাকি 'হাই-রিস্ক'৷ তা বেশ বাপু, তোমার রিস্ক নিয়ে তুমি থাক বসে৷ আমি নাহয় হাঁটাহাঁটিটা একটু বাড়িয়ে দেব৷

শহরে যেতে আমার ইচ্ছা হয় না৷ আমি বসে বসে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকি৷ ঐ বারান্দার কোণায় দাঁড়িয়ে খুনসুটি করে বেড়াতে আসা যুবক্ যুবতী৷ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে খেলে বেড়ায় কটা প্রজাপতি৷ খসখস করে একটা বেজি দৌড়ে যায় ------ নিশ্চয় সাপ দেখেছে৷ জায়গাটা বেশ জঙ্গলমত হয়ে গেছে৷ থাক গে ----- সবসময় অত সাজানোগোছনো রাখারই বা কি আছে! বরং নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি৷ এমনিতে সারাবছর নদীটা নুড়িপাথর আর ছোট ছোট মাছের সাথে লুকোচুরি খেলে৷ কিন্তু রোগামত সেই নদীটার এখন তেজ কি! মস্ত মস্ত কাঠের বোঝা হুশশ করে ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ কারা সব যেন জঙ্গল থেকে গাছ কেটে কেটে কাঠ চেরাই করে মস্ত মস্ত বোঝা বেঁধে ভাসিয়ে দেয়৷ নদী তাদের ভাসিয়ে নিয়ে পৌঁছে দেয় কত দূরদূরান্তের শহর গাঁয়ে৷ সেখানকার ঠিকাদারেরা নাকি জায়গামত তাদের ধরে ধরে পাড়ে তুলে নেয়, কাঠগোলায় নিয়ে যায়৷ ওরা কেমন করে চিনতে পারে যে ওটাই ওদের কাঠ? নাকি সেখানেও যার গায়ে জোর বেশী, সে খপাত্ করে দখল করে নেয়?


চিত্র সৌজন্য:: দ্বৈপায়ন বসু
***************************************************

আজ ওই বাড়িটা খালি বলেই বোধহয় বাহাদুররা কোথায়ও গেছে৷ সামনের দিকটা একেবারে চুপচাপ৷ আমারও আজ কোথাও বেড়োতে ইচ্ছে করছে না৷ কোথা থেকে একটা কাঠবিড়ালি এসে বারবার জানালাটায় ঠোকাঠুকি করছে৷ভেতরে ঢোকার ইচ্ছা৷ উঠে খুলে দিলেও হয় ----- ধুস ইচ্ছে করছে না, থাকগে৷ আজকে আর রান্নাবান্না করে কাজ নেই, স্যুপ করে নেব৷ ঘরদোরও অত রোজরোজ সাফ করার কিছু নেই৷

সকাল হয়ে গেছে কি? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ঠিক করে৷ মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে আর চোখটা ঝাপসামত৷ কাল রাতে ঘুমের মধ্যে আচমকা মারাত্মক বুকেপিঠে ব্যথা শুরু হয়েছিল৷ তারপর কি ব্যথাটা কমে গেল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম? নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম? ব্যথাটা এখন নেই মনে হচ্ছে ----- দেখি পাশ ফিরে উঠি ---- এ: পা টা এত ভারী লাগছে কেন?! কোমর, হাত সবই এমন প্রচন্ড ভারী হয়ে গেল কী করে? একটুও নাড়াতে পারছি না যে ------ পাশ ফিরতেও -পারছি না ----- দম লাগাকে -- হেঁইয়ো --- জোর লাগাকে --- হেঁইয়ো ----- কেমন একটা হালকা দুর্গন্ধ লাগছে নাকে ---- বর্জ্যের গন্ধ ---- জানলাটাও কেমন ঝাপসামত ----- মুঠোফোনটা বেজে ওঠে ---- 'ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে-এ-এ' -- ডানপাশে পড়ে আছে ফোনটা --- আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরতে চাই -----হাত ওঠে না ----- ফোন বেজে যায় ---- আওয়াজ বেড়ে বেড়ে তারস্বরে বাজছে এখন ----- একবার , দুবার ---- পাঁচবার ------ হাত এগোয় না, এগোতে পারে না৷


********************************************

বাহাদুর আর ওর বউয়ের আজ অনেক কাজ৷ বাড়িটা, তার চারপাশের বাগানটুকু পরিস্কার করতে হবে৷বারান্দায় কাঠবিড়ালি, পাখি, ইঁদুরে যথেচ্ছ নোংরা করেছে৷ এক সপ্তাহ বুকিং ছিল না, তাই ওরা একটু নিজেদের গ্রাম থেকে ঘুরে এলো৷ কালকেই আবার একটা পরিবার আসবে, আজকের মধ্যেই সবটা সাফ করতে হবে৷ বউ বাগানের এদিকে এসে কেমন একটা গন্ধ পায়, পচামত গন্ধ, খুব হালকা৷ ভাবে নিশ্চয় কুকুর, বেড়াল, হনুমানে নোংরা করে গেছে৷ তীক্ষ্ণচোখে এদিক ওদিক তাকায়, কিছু চোখে পড়ে না৷ একটু এগিয়ে আসে, পাশের বাড়ির দিকে৷ জানলাটা বন্ধ৷ গন্ধটা একটু বেড়ে যায় ----- বউটা অবাক হয়ে আরও একটু এগোয় ----- গন্ধ আরও বাড়ে --- আর তক্ষুণি ওকে চমকে দিয়ে জানলার ওপার থেকে বাজতে শুরু করে 'ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে-এ-এ' ------ অনেকক্ষণ ধরে বেজে বেজে থেমে যায় ---- বউটা যত এগোয় গন্ধ তত বাড়ে৷ হঠাত্ ওর চোখ যায় জানলার নীচের দিকে, একটুখানি ফাঁক আছে, সেখান দিয়ে লাইন ,করে ঢুকে যাচ্ছে পিঁপড়ের সারি ---- পাশ দিয়ে এমনি দু'একটা পোকামাকড়ও ------- 'ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে-এ-এ' ---- আবার বাজে ------ আবার থামে ----- আবার বাজে৷

No comments:

Post a Comment