ছোটবেলায় মাঝে মাঝে আত্মীয়স্বজন অথবা পাড়াপড়শিরা আমাকে "উপোস' শেখাতে চাইতেন৷ এদিকে খামোখা উপোসটুপোস আমার পোষায় না কোনকালেই৷ একটু বড় হওয়ার পর শুভার্থীরা আমার শ্রবণসীমার মধ্যে; 'মেয়ে হয়ে জন্মিয়েও উপোস করে না, কি অলক্ষ্মী মেয়ে বাবা! আর মা'কেও বলিহারি, মেয়েকে শেখায়ও না' জাতীয় বাক্যাংশ বেশ স্বর চড়িয়েই উচ্চারণ করতেন৷ কিন্তু উপোসটুপোস আমার দ্বারা কোনদিনই হয় নি৷ গান্ধিজীর সম্পর্কে পড়তে গিয়েও প্রথম কথাই মনে হয়েছিল 'বাপরে না খেয়ে দিনের পর দিন থাকে কি করে! আয়ত্ত্বের মধ্যে খাবার আছে কিন্তু দিনের পর দিন খাচ্ছে না, কি সাংঘাতিক সংযম'৷ বেশ বড় হয়ে জানলাম 'সাল্লেখানা'-- জৈনদের একটি রীতি, যাতে এক এক করে বিভিন্ন খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করে শেষপর্যন্ত অনশনে দেহত্যাগ --- সেও বড় অবাক করেছিল৷
তো বলতে নেই, খাবারদাবারের অভাব কখনও টের পেতে হয় নি, আর শখ করে না খাবার ইচ্ছাও কখনও হয় নি৷ অফিস থেকে এসে রাত্রিবেলা বেশ মুসুরডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা আর একটা মাছের তরকারি দিয়ে গরম গরম চারটি ভাত নিয়ে বসে খেতে খেতে নেট ঘাঁটি, জিমেল, ইয়াহুমেল, আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া ঘাঁটতে গিয়ে দেখি ধর্মতলার দখল নিয়ে সিপিএম আর তৃণমূলে ফের ঝগড়া খেয়োখেয়ি শুরু হয়েছে৷ তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য জুড়ে মমতা ব্যানার্জীর অনশনের বর্ষপূর্তি পালন করবে৷ ২৫ দিনের অনশন, তারই বর্ষপুর্তি৷ কে জানে, হয়ত আগামী বছর থেকে কে চন্দ্রশেখর রাওয়েরও অনশন বর্ষপুর্তি উত্সব হবে, সাথে "তেলেঙ্গানা' রাজ্যজয়ের সাফল্যের উত্সব৷ আহা দশদিনের অনশনের কতবড় সাফল্য!!
২০০৬ এর নভেম্বরের এক শীতার্ত বিকেলে এক মেয়ের ক্লান্ত ধীরস্বরে টেনে টেনে বলা কথাগুলো কানে ভেসে আসে, "How shall I explain? It is not a punishment, but my bounden duty…” বড় ক্ষীণ সেই কণ্ঠস্বর উপেক্ষা করে হেঁটে চলে যেতে, অন্যত্র মনোযোগ দিতে বড় ইচ্ছে হয়, কিন্তু পারা যায় না, কিছু একটা ছিল সেই কণ্ঠে যা শুনতে বাধ্য করে৷ এ কণ্ঠ সেই আশ্চর্য মেয়ের, ২০০০ সালের নভেম্বর মাস থেকে যাঁর পেটে একদানাও খাদ্য যায় নি, ঠোঁট, জিভ, তালু পায় নি একবিন্দু জলের স্পর্শ, শুধু মহামান্য ভারতরাষ্ট্র তাঁর নাকের মধ্যে নল ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে ঠেসে দিয়েছে কিছু কিছু তরল, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে৷ সে মেয়ে চুল আঁচড়ায় নি সেই ২০০০ থেকে আজ পর্যন্ত, সে মেয়ের দাঁত মাজা বলতে শুকনো কাপড় দিয়ে দাঁত মুছে নেওয়া, স্পিরিটে ভেজা তুলো দিয়ে ঠোঁট মুছে নেওয়া, যাতে একবিন্দু লালাও গলা দিয়ে না যায়, আকৈশোর অভ্যস্ত মাসিক ঋতুচক্রও বন্ধ হয়ে গেছে কবেই, সেই আশ্চর্য মেয়ে তবুও বেঁচে আছেন, সেই মেয়ে যখনই পারেন, নাক থেকে নলটা সরিয়ে দেন৷ ছোট্টখাট্ট চেহারার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে অত শক্তি!চিত্রাঙ্গদার দেশের সেই আশ্চর্য্ মেয়ে, "ইরম শর্মিলা চানু' --- মণিপুরে AFSPA (Armed Force Special Powers Act) প্রত্যাহারের দাবীতে যিনি আমরণ অনশন শুরু করেছেন ২০০২এর নভেম্বর থেকে, এই ২০০৯এ সেই অনশন দশ বছরে পড়ল৷
মণিপুরসহ উত্তরপূর্ব ভারতে আর্মড ফোর্স স্পেশ্যাল পাওয়ারস অ্যাক্ট চালু হয় ১৯৮০ সালে৷ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এই অ্যাক্টের বলে, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী যে কোন লোককে তল্লাসি, গ্রেপ্তার বা গুলি করে হত্যা করতে পারে কোনওরকম ওয়ারেন্ট ছাড়া, এবং সৈন্যবাহিনীর কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে অথবা আইনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি চাই৷ এই অ্যাক্টের বলে বলীয়ান হয়ে সৈন্যবাহিনীর জওয়ানরা দাপিয়ে বেড়ায়, অবাধে লুঠতরাজ ধর্ষণ চালায়৷ ২রা নভেম্বর ২০০২ সালে একদল উগ্রপন্থী বিদ্রোহি একটি সেনাছাউনিতে বোমবাজি করে, প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত অসম রাইফেলসের কিছু জওয়ান মালম বাসস্ট্যান্ডে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে ১০ জনকে মেরে ফেলে৷ এই ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে গোটা মণিপুর৷ এরই প্রতিবাদে এবং অ্যাক্ট প্রত্যাহারের দাবীতে ২৮ বছর বয়সী ইরম শর্মিলা শুরু করেন আমরণ অনশন৷ অনড়, অন্ধ ভারতরাষ্ট্র অ্যাক্ট প্রত্যাহার করে না ---- শর্মিলাকেও মরতে দেয় না --- বন্দী করে দিল্লী নিয়ে এসে অল ইন্ডিয়া মেডিকেল ইন্সটিট্যুটের এক খুপরি কেবিনে রেখে নাকে ঠুসে দেয় নল৷ সরকার যায়, সরকার আসে, অ্যাক্ট থেকে যায় জগদ্দল পাথরের মত৷ প্রতিবছর নিয়ম করে তাঁকে একবার মুক্তি দেওয়া হয়, কারণ 'আত্মহত্যার চেষ্টা'র অভিযোগে কাউকে গ্রেপ্তার করলে তাঁকে একবছরের বেশী বন্দী রাখা করে যায় না, কদিন পরেই আবার গ্রেপ্তার করা ও দশ বছর ধরে একই নাটকের পুনরাবৃত্তি৷ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের বৃহত্তম তামাশা৷
অবাক লাগে৷ ভীষণ অবাক লাগে, হাতেগোণা দু একটা মানবাধিকার সংগঠনের কিছু লেখাপত্র, দু একটা মিটিং মিছিল, ২০০৬ এ দেওয়া সাক্ষাত্কারের ক্লিপিং নিয়ে হইচই ছাড়া মূলস্রোতের রাজনীতিতে এই শান্ত কঠিন প্রতিবাদের কোনও প্রভাবই পড়ে নি কখনও৷ মমতা ব্যানার্জী ২৫ দিন অনশন করে জাতীয় মিডিয়ায় যে পরিমাণ প্রচার পেলেন, তার শতাংশের একাংশও দেখিনি শর্মিলাকে নিয়ে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যগঠনের ঘোষণায় দূরদর্শনের পর্দায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের ১১ দিনের অনশনভঙ্গের ছবির সঙ্গে ভুলেও শর্মিলার নাম উচ্চারণ করা হয় না৷ কারও মনেও হয় না, কেউ জিজ্ঞাসাও করে না ১১ দিনের অনশন কোন মন্ত্রবলে ১০ বছরের অনশনের চেয়ে মহান হয়ে উঠল৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার মাওবাদী উগ্রপন্থীদের কাছে অস্ত্র নামিয়ে রেখে আলোচনায় বসার অনুরোধ জানাচ্ছেন --- ক্যাবিনেট মন্ত্রী থেকে পাড়ার পঞ্চাদা পর্যন্ত সব্বাই বলছে উগ্রপন্থা কখনও সমর্থনযোগ্য নয়, কোনও অন্যায়ের সমাধান ওভাবে হয় না৷ কথাটা আমিও মানি৷ কিন্তু কি আশ্চর্য! কি পরমাশ্চর্য! শর্মিলা তো কোনও উগ্রপন্থার আশ্রয় নেন নি, বরং জাতির জনক প্রদর্শিত অহিংসার পথে গেছেন, তবুও কারও একবারও তাঁর সাথে কথা বলার, আলোচনায় বসার কথা মনে হয় না! এবং তারপরেও আমরা আশা করি যে ছিন্নভিন্ন মণিপুরীগণ হিংসার পথে যাবেন না!!!
ভারতবাসী হিসাবে গর্বে আমার মাথা হিমালয় ছাড়িয়ে যায় , শর্মিলার দেশের মেয়ে আমি --- ভারতবাসী হিসাবে লজ্জায় আমি মাটিতে মিশে যাই, শর্মিলার দেশের মেয়ে আমি, ঐ অকথ্য অত্যাচারের দায়ভাগও যে আমার --- আমাদের৷
খুব ভালো লাগল। কত কিছু জানি না।
ReplyDeleteasambhab bhaalo laagala.
ReplyDeletesara shorir mon ek abyokto koste achchhonno holo---jantam na ei bhayaboho atyacharer golpo--er shesh kothay---kobe---Nina
ReplyDelete