আমাদের বালিকা বিদ্যালয়টি আমাদের এলাকায় "ভাগাড়পাড়ার স্কুল' নামে পরিচিত ছিল। ছাত্রীরা অধিকাংশই প্রথম কিম্বা দ্বিতীয় প্রজন্মের পড়ুয়া। টানা ১০-১২ বছর মাধ্যমিকে একটিও ফার্স্ট ডিভিশান না পাওয়ার রেকর্ডবিশিষ্ট এই স্কুলে "নাকি' একটা পাঠাগার ছিল। নাকি লিখলাম, কারণ সে পাঠাগারের অস্তিত্ব আমরা স্কুলজীবনে কোনওদিন অনুভব করিনি। আমাদের কোন গল্পের বইয়ের ক্লাস ছিল না, কোনওদিন কোনও বই ইস্যু করা তো দূরে থাক, ক্লাসে বসে পড়তেও কেউ দেয় নি। কিন্তু প্রতিবছর যখন দিদিমণিরা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের জন্য বই কিনতে যেতেন, তখন পাঠাগারের বই কেনা নিয়েও তাঁদের টুকটাক আলোচনা কানে আসত। টিচার্সরুমে কিছু প্রাচীন ও গম্ভীর আলমারীর গর্ভে সেইসব বইরা অতিযত্নে তালাবন্ধ হয়ে থাকত।
স্কুলের সময় ছিল বছরে নয় মাস, সকাল সোয়া ছটা থেকে সাড়ে দশটা, আর শীতের তিনমাস সকাল সাতটা থেকে সাড়ে দশটা। এই সাড়ে তিন কিম্বা চার ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত সিলেবাস শেষ করতে হত। তাই সময়াভাবে, নাকি "অগা বগা মেয়েগুলো বই নিলে নষ্ট করে ফেলবে' এই ধারণার জন্য, গল্পের বইয়ের ক্লাস ছিল না তা ঠিক জানি না।
এর অনেক বছর পরে যখন সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার দেওয়া শুরু হয়, তখন বেশ কিছু স্কুলে শুনেছি ছাত্রদের কম্পিউটার ধরতে দেওয়া হত না এবং এটি অত্যন্ত দামী জিনিষ বিধায় যত্ন করে কম্পিউটারের ঘরে তালা দিয়ে রাখা হত। কোনও স্কুল যদি কম্পিউটার জানা কাউকে পার্টটাইম শিক্ষক হিসাবে পেয়ে যেত, তাহলে সেই শিক্ষক থাকার সময়টুকু তাঁর তত্তÄআবধানে ছাত্রছাত্রীরা কম্পিউটারে হাত দিতে পারত। আমাদের সেই বালিকা বিদ্যালয়ে অবশ্য এখনও সরকার থেকে কম্পিউটার দেয় নি, তবে লাইব্রেরীটা এখনকার ছাত্রীরা পায় কিনা ঠিক জানি না।
এতগুলো কথা, না পাওয়ার কথা বললাম তার কারণ আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে বিভিন্ন রিসোর্সের কার্য্যকরী ব্যবহার খুব কম। কম্পিউটারবিহীন যুগে লাইব্রেরী হতে পারত একটি চমত্কার তথ্যভাণ্ডার। দিদিমণিরা অনেকেই তাঁদের ব্যক্তিজীবনে বেশ পড়ুয়া ধরণের ছিলেন, সে তাঁদের কথাবার্তায় বোঝা যেত। কিন্তু ছাত্রীদের বিভিন্ন তথ্য খুঁজে বের করতে উত্সাহ দেবার কথা তাঁদের কখনও মনেও হয় নি। পরে যখন কম্পিউটার এলো, তখনও স্কুলগুলিতে এটিকে ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখার কথা শিক্ষকগণ সহসা ভেবে উঠতে পারেন নি। এ তো গেল যেসব রিসোর্স আছে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করতে পারে না তার কথা। এবারে যদি নেই-নেই এর তালিকায় যাই তো অবস্থা আরও খারাপ। ভারতের বহু এলাকাতেই ছেলেমেয়েরা বেশ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যায় এবং পৌঁছে দেখে হয় শিক্ষক/শিক্ষিকা আসেন নি, অথবা শ্রেণীকক্ষের ছাদ দিয়ে জল পড়ছে বা অন্য কোনও কারণে সেদিন ক্লাস হবে না। সরকারী ও আধা সরকারী স্কুলগুলির দুর্দশার বিভিন্ন গল্প সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তাতে সরকারের টনক খুব একটা নড়ে এমন দেখা যায় না। তাবে হাতে পয়সা থাকলে দামী বেসরকারী স্কুলগুলিতে বাত্সরিক পাশ হাজার বা তদুর্ধ বেতন দিয়ে পড়ালে অবশ্যই উন্নততর পরিষেবা পাওয়া যায়। আর হাতে পয়সা থাকলে দেখেবেছে ভাল স্কুলও পছন্দ করা যায়। তবে সে অন্য গল্প।
তো, সরকার পরিচালিত প্রথাগত শিক্ষার দুরবস্থা যখন সর্বজনবিদিত এবং দ্রুত উন্নতির তেমন কোন লক্ষণও যখন চোখের সামনে ছিল না, তেমনই এক সময়ে, ২০০৬ সালে ড: সুগত মিত্র, এন আই আই টি'র রিসার্চ উইঙের তত্কালীন প্রধান, অনুভব করেন যে ডিজিটাল যুগ ভারতের মত দেশে যে বিভাজন বয়ে আনবে তা ভয়ংকর। যাদের হাতে কিছু টাকাপয়সা আছে, তারা কমপিউটার ও ইন্টারনেটকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু ভারতবাসীর এক বৃহদংশই থেকে যাবে কমপিউটার না জানা মূর্খ হিসাবে। যে দেশের অনেক অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষাই এক বিলাসিতা, সেখানে কমপিউটার শিক্ষার কথা তো ভাবাই যায় না। তাঁর নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি ন্যূনতম তদারকিতে কমপিউটার শিক্ষার জন্য খুব ছোট পরিসরে এক অভিনব ব্যবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেন। তাঁর এই প্রকল্পের নাম তিনি দেন "হোল ইন দ্য ওয়াল'।
দিল্লীতে এন আই আই টি'র কালকাজি অফিসের বাইরে পাঁচিলের গায়ে একটি গর্ত করে ফোকর বানিয়ে তাতে একটি হাইস্পীড ইন্টারনেট কানেকশানযুক্ত পিসি বসিয়ে দেন। পিসিটা টাচস্ক্রিন, কিবোর্ডের বালাই নেই, একটা মাউস অবশ্য আছে। পাঁচিলের বাইরে একটা আবর্জনাপূর্ণ পোড়ো জমি, সাধারণত আশেপাশের বস্তির লোকের প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই ব্যবহতৃ হত। দেওয়ালের ফোকরটা এমন উচ্চতায় করা যাতে ১২-১৩ বছর পর্যন্ত বয়সের বাচ্চারা স্বচ্ছন্দে হাত পায়। নিকটবর্ত্তী একটা গাছে একটা ভিডিও ক্যামেরা লাগিয়ে রেখে পিসিটা অন করে রিমোট নিয়ে ড: মিত্র অফিসের ভেতর থেকে লক্ষ রাখেন।
সুগত মিত্র যা দেখেন, তা প্রথম শুনলে রীতিমত অবিশ্বাস্য লাগে। আশেপাশের বস্তির ৬-১২ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা ওরকম দেওয়ালের ফোকরে একটা কমপিউটার রাখা দেখে সেটা নিয়ে খেলতে শুরু করে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটা ব্যবহার করতে শিখে যায়। মনে রাখতে হবে যে অধিকাংশ শিশুই খুব সামান্য লিখতে পড়তে জানে আর ইংরেজী প্রায় না জানার মতই। ওরা জানেও না কোনটা কিবোর্ড, কাকে বলে মাউস, কিম্বা কমপিউটার কার নাম। কিন্তু ওরা নিজে নিজেই শিখে যায় এই যন্ত্রটা কেমন করে ব্যবহার করতে হয়। ইন্টারনেটই বা কীভাবে ব্যবহার করা যায়। ডিজনি ডট কম ওদের সবচেয়ে প্রিয় সাইট, যদিও এই নামটা বললে ওরা কিছুই বুঝতে পারে না। আর তার পরেই ওদের প্রিয় হল মাইক্রোসফট পেইন্ট। সাধারণভাবে বাচ্চারা ছবি আঁকতে, রং নিয়ে খেলতে ভালবাসে। এই বাচ্চারা সমাজের যে অংশে বাস করে, তাতে রঙপেন্সিলের বিলাসিতা তাদের জন্য নয়। তাই এই যন্ত্রটায় ঐ রং দিয়ে আঁকিবুকি কাটা যায় দেখে ওদের খুশীর সীমা নেই। মূলত: এই দুটো ওরা নিজেরাই খুঁজে নেয় এবং এদুটো নিয়েই খেলতে থাকে। কিছুদিন ধরে লক্ষ করে ড: মিত্র যখন দেখলেন ওরা আর কিছু তেমন ব্যবহার করছে না, তখন তিনি নিজে গিয়ে একদিন একটি এম্পিথি ফ্রাইল বাজিয়ে শোনান। ওরা অবাক হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে "আরে এটা টিভির মত? নাকি রেডিওর মত?' ড: মিত্র ওদের শুধু বলেন যে তিনি ওটা বাজাতে জানেন, কিন্তু তার চেয়ে বেশী আর কিছু তাঁর জানা নেই। এটুকু বলে তিনি আবার আড়ালে চলে যান। সাতদিন বাদেই দেখা গেল ওরা দিব্বি ফ্রি এমপিথি প্লেয়ার নেট থেকে নামিয়ে তাতে নিজেদের পছন্দের সব গান যোগাড় করে শুনছে। যথারীতি "এমপিথি প্লেয়ার' বা "ওয়েবসাইট' জাতীয় শব্দ ওদের কাছে অচেনা। কিন্তু ওরা নিজেরাই খুঁজে বের করেছে হিন্দীগানের সম্ভার। জিগ্যেস করলে বলছে "দেখো গানটা খুঁজে টেনে এনে এই বাক্সটায় ঢুকিয়ে দিলে নিজে নিজেই বাজতে থাকে'। ড: মিত্র'র এই নিরীক্ষা'র কথা যখন বেশ প্রচারিত, তখন এক সাংবাদিক এসে একটি বাচ্চাকে জিগ্যেস করেন "কমপিউটার সম্বন্ধে তুমি কী জান?' বাচ্চাটি প্রায় আকাশ থেকে পড়ে, কারণ "কমপিউটার' শব্দটি ওদের কাছে অচেনা। কার নাম সিপিইউ আর কেই বা মাউস, এসব ওরা জানে না। কিন্তু তাতে ওদের ভারী বয়েই গেছে। যন্ত্রটা অন্ অফ্ করতে আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে ওরা জানে। নিজেদের মত করে কিছু শব্দ ওরা নিজেরাই উদ্ভাবন করে নেয়। মাউস পয়েন্টার হয় সুই (ছুঁচ'এর হিন্দী) আর আওয়ারগ্লাস হয় ডমরু। ওদের ভাষায়, ঐ জিনিষটা (কম্পিউটার) যখন কোন কাজ করে, তখন সুইটা ডমরু হয়ে যায়। ড: মিত্র আরও দেখেন যে বাচ্চাদের মধ্যে থেকেই এক দুজন খুব চটপট সব বুঝে নিয়ে অন্যদের বুঝিয়ে দেয়, সর্দারগোছের দু একজন নজর রাখে যাতে সবাই অন্তত কিছুক্ষণ করে ওটা নিয়ে খেলা করতে পারে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যপার হল ইন্টারনেট, যাতে কিনা ইংরিজীরই আধিক্য, এবং এই বাচ্চারা ইংরিজী হয় খুব সামান্য জানে, অথবা জানেই না, তাতে ওদের কোন অসুবিধে হয় না। ওরা দিব্বি নিজেদের মত করে খুঁজেপেতে শিখে নিতে থাকে, ইংরিজীও দ্রুত বুঝতে থাকে।
তো, ড: মিত্রর এই নিরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ন্যূনতম নজরদারীতে প্রাথমিক শিক্ষার একটা মডেল গড়ে তোলা। তাঁর হিসেব অনুযায়ী তাঁকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ৫ বছর ধরে ১০০,০০০ কিয়স্ক নিয়ে "হোল অন দ্য ওয়াল' প্রকল্পটি চালাতে দিলে ৫০০ মিলিয়ন শিশু কমপিউটার ব্যবহার করতে শিখে যাবে। একটা গোটা "কম্পুকানা' প্রজন্ম "কম্পুজানা' প্রজন্মে পরিণত হবে। এর জন্য খরচ হবে দুই বিলিয়ন ডলার, যা ৫০০ মিলিয়ন শিশুকে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত করার খরচের চেয়ে বেশ অনেকটাই কম। এই খরচ বহন করতে হবে সরকারকেই, কেননা প্রাথমিক শিক্ষা সরকারেরই দায়িত্ব। এটি ভারতবাসীর সাংবিধানিক অধিকারও বটে। ২০০৭ সালে একটি সাক্ষাত্কারে ড: মিত্র জানিয়েছিলেন যে কেন্দ্রীয় এবং কিছু কিছু রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তিনি প্রস্তাব পেয়েছেন, তবে টাকা না পাওয়া পর্যন্ত কোন নাম জানাতে চান না। ২০০৮ পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্স করপোরেশান এন আই আই টি'র সাথে যৌথ উদ্যোগে ৩০০টি কিয়স্ক স্থাপন করেছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, যার মধ্যে মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডও আছে। ২০০৯এ এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি যাওয়ার কথা।
এইবার কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্যসরকার যদি একটু নড়েচড়ে বসে এগিয়ে আসেন তো তাঁদেরও প্রত্যন্ত প্রান্তে স্কুল স্থাপন শিক্ষক/শিক্ষিকা ও অন্যান্য পদে লোকনিয়োগ এবং পরিচালন ইত্যাদির ঝক্কি অনেক কমে যায় আর শিশুরাও মনের আনন্দে শিখতে পারে। শুরুতে পাঠাগারের কথা বলছিলাম না, এখন তো ইন্টারনেটই এক মহা-পাঠাগার। যত বেশী শিশু এর সুযোগ নিতে পারবে ততই ভারতের মেধাসম্পদ বৃদ্ধি পাবে। মনের মধ্যে একটুখানি আশা জেগে থাকে, হয়ত আর কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতের সমস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলেই অন্তত একটি দেওয়াল পাওয়া যাবে, যার ফোকরে রাখা আছে একটি টাচস্ক্রিন পিসি আর একটি মাউস, আর সেই অঞ্চলের নিজস্ব ভাষায় নিজেদের পরিভাষা তৈরী করে নিয়ে একঝাঁক কুচোকাঁচা জগত্ জোড়া জালের মধ্য থেকে তুলে আনছে জ্ঞান ও তথ্যের ভাণ্ডার, চকচকে চোখে বুঝিয়ে দিচ্ছে একে অপরকে।
তথ্যসূত্র:
http://en.wikipedia.org/wiki/Minimally_Invasive_Education
http://www.hole-in-the-wall.com/
http://hole-in-the-wall-education.blogspot.com/2007/02/detailed-interview-with-dr-sugata-mitra.html
http://www.infonomia.com/if/articulo.php?id=265&if=59
No comments:
Post a Comment