খোঁজাখুঁজি

Friday, April 22, 2011

ঝর্ণা যেথায় বসত করে

মাইকের অত্যাচারে আর আনন্দের ওভারডোজে পুজোর সময় কলকাতা বা আশেপাশে থাকা যাবে না বলে পুজোর দুমাস আগে থেকেই হন্যে হয়ে বেড়ানোর প্ল্যান শুরু করেছিলাম এখান ওখান সেখান করতে করতে সিকিম ফাইনাল হল বন্ধু অরিজিৎও সুমনা, ঋক, ঋতিকে নিয়ে যাচ্ছে, একই সময় গেলে একসাথে হইহল্লা করতে করতে যাওয়াও হবে আর গাড়ীভাড়াও শেয়ার করা যাবে এইসব সাত্পাঁচ ভেবেটেবে ঠিক হল উত্তর সিকিম আমরা একসাথে 'ফর্চুনা রেসর্টসের প্যাকেজে ঘুরব, আর বাকীটা যে যার মত





আমরা যেদিন উত্তর সিকিমের দিকে রওনা হব, সেটা বিজয়া দশমী অর্থাৎ 'দসেরা' সিকিমে মূলতঃ হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের লোকের বসবাস 'দসেরা' নেপালী ও সিকিমিজ হিন্দুদের বেশ বড় উৎসব অধিকাংশ লোকজন পাঁচ থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ী বসে রয়েছে ফর্চুনার অধিকাংশ ড্রাইভারও ছুটিতে ফলে তারা এদিক ওদিক থেকে একজন বৌদ্ধ ড্রাইভার যোগাড় করে আমাদের পিক-আপের জন্য পাঠাল অতএব সকাল দশটায় যে যাত্রা শুরু হওয়ার কথা, তা শুরু হল বেলা পৌনে বারোটা এবং গ্যাংটকের সীমা ছাড়িয়ে অল্প একটু উঁচুতে উঠতেই বোঝা গেল 'উত্তর সিকিম' যাব শুনেই গ্যাংটকের লোক কেন বিরস মুখে তাকাত এমনিতে সিকিমিজরা বেশ হাসিখুশী ধরণের লোক, কিন্তু ঐ উত্তর সিকিম শুনলেই কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ত রাস্তা অসম্ভব খারাপ, প্রায় নেই বললেই চলে অরিজিৎ নাম দিয়েছিল 'নেই রাস্তা' সত্যিই তাই পাসাং, মানে আমাদের ড্রাইভার খানিকটা গিয়েই বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল 'ইয়ে কাঁহা ফাঁসায়া মেরেকো', আবার আমাদের বলে তোমরা জান তো কোথায় কোথায় যাবে? আমি ঠিক নিয়ে যাব এদিকে রাস্তায় অনেকখানি গভীর গাড্ডা, এমন কাদা আর এত ভাঙা যে গাড়ী এগোতে লাগল পা টিপে টিপে, দুলে দুলে, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে; ওদিকে পাসাংএর দেখি মুখ শুকিয়ে গেছে জিগ্যেসবাদ করে জানা গেল যে ও এইদিকে কক্ষণো আসে নি, গ্যাংটক-শিলিগুড়ি রুটে ট্রাক চালায় ওকে ওর মালিক জোর করে ফর্চুনার কাছে পাঠিয়েছে এই ট্রিপটা খেটে দেওয়ার জন্য নয় হাজার টাকা আর ডিজেলের দাম পাবে ও খাওয়া দাওয়া তো ট্যুরিস্টরা যেখানে খাবে সেখানেই ওর ফ্রী পাসাং যেহেতু এদিকে কোনোদিন আসে নি, তাই ফর্চুনার অন্য একটা গাড়ীকে ওর অনুসরণ করার কথা, ওদিকে সেভেন সিস্টার্স ফলসের পরেই সে ড্রাইভার তার জিপ নিয়ে কোথায় হাওয়া পাসাং বেচারা ঐ নেই-রাস্তায় যত জোরে যাওয়া সম্ভব তত জোরেই ছোটাল অগ্রবর্তী জিপকে ধরার জন্য


আমাদের দুপুরে খাওয়ার কথা ছিল ফোডোঙে, কিন্তু সেই জিপের খোঁজে ছুটতে গিয়ে আমরা সেসব  পিছনে ফেলে এসেছি সামনে একটা 'ঘাট' যার দুদিকেই গাড়ীর কাতার 'ঘাট' অর্থাৎ কিনা সেখান দিয়ে একটি মাত্র গাড়ীই যেতে পারে তাই দুদিকে গাড়ী দাঁড় করিয়ে এক এক করে গাড়ী পার করানো হচ্ছে প্রথম আধঘন্টা উপর থেকে নেমে আসা গাড়ীগুলো ছাড়া হবে, পরবর্তী আধঘন্টা নীচের গাড়ীগুলো উপরে যাবে সেই জায়গাটা ভয়ানক ফুটখানেক গভীর কাদা আর এদিকে পাহাড়ের একটা পাথর রাস্তার প্রায় উপরে এতটাই ঝুলে রয়েছে যে সেখান দিয়ে ছোট ট্রাক যেতে পারলেও বড়সড় পাঞ্জাব লরি যেতে পারবে না আবার এদিকে প্রায় চুলের কাঁটাসম একটি বাঁকও আছে পুরো জায়গাটা একবারে পেরোতে হবে, আটকে গেলেই সর্বনাশ! তা, ব্যপারস্যাপার দেখে আমরা সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়া স্থির করলাম এখানে সেই অগ্রবর্তী গাড়ীরও দেখা পাওয়া গেল ধীরে ধীরে সেই জায়গা পেরোনও গেল নিরাপদে আমাদের আজকের গন্তব্য লাচেন| চুংথাং থেকে রাস্তাটা দুইভাগ হয়, একদিকে লাচেন-চু নদীর সঙ্গে গিয়ে পৌঁছতে হয় লাচেন এবং সেখান থেকে আরও ওপরে গুরুদোংমার হ্রদ আরেকদিকে লাচুং-চু নদী পাশে পাশে কলকল বকরবকর করতে করতে পৌঁছে দেয় লাচুং এবং সেখান থেকে ইয়ুমথাং ভ্যালি, জিরো পয়েন্ট ইত্যাদি


তা, আমরা তো লাচেন-চুয়ের দেখানো রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলাম এদিকে কোথাও কোথাও কিশোরী ঝর্ণারা হু-উ-ই উঁচু থেকে লাফিয়ে নেমে দিব্বি রাস্তার ওপর দিয়েই খলবলিয়ে বয়ে গিয়ে আবার খাদে ঝাঁপ দিচ্ছে ---- আরও নীচে হয়ত কোন রাস্তাকে এমনি করেই ভাসিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে কে জানে কোথায় বয়ে চলে যাচ্ছে --- হয়ত আরও নীচে গিয়ে অনেক লোকজন দেখে হয়ত একটু লজ্জা পেয়ে নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে সেই রাস্তা অথবা নেই-রাস্তা দিয়ে চলল আমাদের গাড়ী চুংথাং পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ অন্ধকার হয়ে গেল অতঃপর হেডলাইটের আলো সম্বল করে বাঁইবাঁই করে বাঁক ঘুরে ঘুরে আমরা লাচেনের দিকে উঠতে লাগলাম কিছুদূর ওঠার পর আরেক বিপত্তি| সামনের একটি গাড়ী খারাপ হয়ে গেছে হিমালয়ের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রাস্তায় কোনও গাড়ী খারাপ হলে, পাশে যতই জায়গা থাকুক অথবা রাত্তির হয়ে যাক -- বাকী গাড়ীরা কক্ষণো ঐ গাড়ীকে একা রেখে সামনে এগিয়ে যাবে না ফলে পরপর বারো তেরোটা গাড়ী দাঁড়িয়ে গেছে; সব ড্রাইভারই চেষ্টা করছে খারাপ হয়ে যাওয়া গাড়ীটাকে সাহায্য করতে অবশেষে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বারো তেরোটা গাড়ীর এক লম্বা মিছিল নিয়ে আমরা লাচেনে পৌঁছোলাম পথে মাঝেমধ্যে ঘুমভাঙা চোখে লোকজন বারান্দায় এসে আমাদের মিছিল লক্ষ করছিল পাহাড়ী জায়গায় লোক সূর্য্যের সাথে জাগে আর সূর্য্যের সাথেই ঘুমায় রাত সাড়ে আটটা সেখানে প্রায় মাঝরাত.
পরেরদিন ভোর ছটায় উঠে রওনা দিলাম গুরুদোংমার হ্রদের দিকে হিমালয়ের একটা নিয়ম হল আকাশে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা করে বেলা বারোটার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে হয়, কারণ অনেকসময়ই বারোটার পরে আবহাওয়া খুব খামখেয়ালী হয়ে যায় গুরুদোংমার হ্রদের উচ্চতা ১৭০০০ ফুট এর মধ্যে শেষ দুই কিলোমিটারে প্রায় দুই হাজার ফুট উঠতে হয়, ফলে অত্যন্ত সুস্থ লোকেরও হ্ঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার্ সম্ভাবনা থাকে শীতের দিনে রাস্তা সম্পূর্ণ জমে গেলে গাড়ীর চাকায় চেন বেঁধে টেনে শেষ দুই কিলোমিটার তোলা হয় এই সব রাস্তায় যাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় হল ট্রেক করে যাওয়া, তাতে মানবদেহ পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে সইয়ে নেয় আমরা যেহেতু একবারে প্রায় সাত আট হাজার ফুট উঠে যাব, তাই সঙ্গে পর্যাপ্ত চকোলেট, পপকর্ণ ইত্যাদি নেওয়া হয়েছে সুয্যিমামা যখন আকাশের সবচেয়ে কাছের পাহাড়চুড়ায় গুড মর্ণিং কিস দিচ্ছেন, ততক্ষণে আমরা হাজার দুয়েক ফুট উঠে গেছি তারপর শুরু হল আমাদের সাথে বরফ চুড়াদের লুকোচুরি খেলা| কখনও তারা বাঁদিকের পাহাড়ের মাথা থেকে টু-কি করে -- সুমনা উল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, কখনও বা সামনের ডানদিক থেকে বরফঢাকা নাকটা দেখিয়েই আমাকে ক্যামেরা তাক করতে দেখে লুকিয়ে পড়ে আস্তে আস্তে তৃণরেখা শেষ হয়ে গেল কোথাও কোথাও তৃণরেখার সামান্য ওপরেই বরফরেখা শুরু হয়ে গেছে, কোথাও বা আবার ঘাস শেষ হওয়ার পর বেশ খানিকটা উদোম পাহাড়, তারপর শুরু হয়েছে বরফ, রোদ্দুর পড়ে তা কখনও সোনা, কখনও বা রূপোর রং ধরছে আস্তে আস্তে বাতাস পাতলা হতে শুরু করল, রাস্তার পাশে একটু উপরে বা নীচে তাকালেই বরফ শুধু বরফ আর যখন দুই কিলোমিটার বাকী, তখনই মূর্তিমান রসভঙ্গ্কারী হয়ে এক মিলিটারিম্যানের আবির্ভাব| ঋতির বয়স পাঁচ পেরোয় নি, কাজেই তাকে গুরুদোংমারের দিকে নেওয়া যাবে না আর নেওয়া নিরাপদও হবে না; কারণ অসুস্থ হলেও ধারেকাছে উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ার কোন বন্দোবস্ত নেই, চার পাঁচ হাজার ফুট নেমে গেলে তবেই পাওয়া যাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা, এখানে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে| এসব শোনার পর আর কেই বা সাহস করে বাচ্চা নিয়ে যাবে তবু আমি আর অরিজিৎ মিলে চেষ্টা করেছিলাম একটা বা দুটো গাড়ীতে করে বাচ্চাদের ও তাদের মায়েদের নীচে পাঠিয়ে আর একটা গাড়ী নিয়ে হ্রদের ধার অবধি যেতে ঐ সাড়ে পনেরো হাজার ফুট উচ্চতায়ও আমাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না| কিন্তু হায় অন্য গাড়ীগুলোর লোকজন খুবই ভয় পেয়েছে, কেউ যেতে রাজী নয়| টিপিক্যাল বাঙালী ট্যুরিস্ট!!! অগত্যা মন খারাপ করে ফেরত আসলাম|


এখানে কয়েকটা নিয়ম উল্লেখ করে রাখি


১) ভারতীয় নাগরিক না হলে লেক গুরুদোংমারে যেতে অনুমতি দেওয়া হয় না, লাচেন থেকে ফেরত আসতে হয়
২) গোটা সিকিমে প্ল্যাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ| সিকিম ট্যুরিজমের পক্ষ থেকে গুরুদোংমারের মত অতি উচ্চ ও দুর্গম স্থানে প্ল্যাস্টিক ব্যাগ না বহন করতে অনুরোধ করা হয়|
৩) সিকিমে গুটখা বা তামাকমেশানো পানমশলা বিক্রীর উপর নিষেধাজ্ঞা আছে এবং তা কঠোরভাবে পালনও করা হয়| ফলে রাস্তায়্ঘাটে লোকে থু-থু করছে, এই দৃশ্য একেবারেই দেখা যায় না|


ফেরার সময় থাঙ্গু থেকে চোপতা ভ্যালী দেখে এলাম লাচেন-চু নদীর পাশে এক মার্শল্যান্ড আর দেখলাম গাছেদের রংবদল, যাকে বলা যায় ইন্ডিয়ান ফল কালারস গুরুদোংমার তো যাবই, উত্তর সিকিমেই আবার যাব এ এমন জায়গা যা প্রতিটা ঋতুতে অন্যরকম হয় অজস্র ঝর্ণা আর নদীর গর্জন গোটা সিকিম ভ্রমণকালে ছিল আমাদের সঙ্গী হয় লাচেন-চু নয় লাচুং-চু, নয় রংপো, নয় রঙ্গীত আর নয়ত তিস্তা ---- কেউ না কেউ সবসময় আমাদের সাথী ছিল, আর ছিল নাম জানা, না জানা র্ঝ্ণারা, গভীর সবুজ গাছ গাছালি আর তীব্রস্বরে গর্জনকারী ঝিঁঝিপোকার দল|


রডোডেনড্রনের বনের মধ্যে দিয়ে লাচুং-চু নদীর কোলে ইয়ুমথাং ভ্যালী, সেই যেখানে গাছশুমারীর পর গাছবাবুরা লিখে রেখে যায় রডোডেনড্রন গাছেদের সংখ্যা, তাদের ছানাপোনাদের খবর, সেই যেখানে নদীর বুকে পাথরের ওপরে লাল টুকটুকে শ্যাওলা গজায় আর রিভারবেড লালে লাল হয়ে থাকে, সেসব গল্প নাহয় আরেকদিন করব


** লেখাটি সচলায়তনের পয়লা বৈশাখ ২০১৮র ই-বুক 'ভ্রমণীয়'তে প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment