আসলে ফেলি একদম দৌড়াতে পারে না তো, তাই ওকে কেউ দলে নিতে চায় না৷ বুড়ি-বসন্তী খেলার জন্য যখন দলভাগ হয়, তখন শুভ্রা আর সুলগ্নার দলে সবাই যেতে চায়৷ আর ওরাও দেখেশুনে বেছেবেছে ভাল দৌড়াতে পারা মেয়েদেরই নেয়৷ ফেলি খুব ওদের দলে ঢুকতে চায়, কিন্তু ওকে দলে নিলেও, 'তুই এখন বোস, ইলা খেলুক' বলে ওকে বসিয়ে দেয় সবাই৷ ইলা, শীলা, টুম্পা, মিনি সব্বাই বেশ দৌড়াতে পারে৷ ফেলি একটু দৌড়িয়েই হ্যা হ্যা করে জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের খেলা দেখে৷ ওর খুব ইচ্ছে করে ওদের মত একটানা দৌড়াতে, একটুও না হাঁপিয়ে সারা বিকেল খেলে যেতে, দৌড়ে সবাইকে হারিয়ে দিতে ------------ হয় না৷ কিছুতেই তা হয় না৷ বিকেলবেলার এই খেলার সময়টুকুর জন্য ফেলি প্রায় সারাদিন অপেক্ষা করে৷ ওর স্কুল তো সেই সকালে, সাড়ে দশটায় ছুটি হয়ে গেলে বাড়ি পৌঁছতে আর মিনিট পনেরো বড়জোর৷ স্কুলে ওদের টিফিনের সময় মাত্র পনেরো মিনিট৷ ওরই মধ্যে খেলে খাও, খেললে খেলো৷ তো সেখানেও ফেলিকে কেউ এমনিতে দলে নিতে চায় না ------ তবে বিশেষ গাঁইগুঁই না করেই নেয়ও৷ তার একটা কারণ আছে৷ 'ফুলেশ্বরী' আসলে স্কুলের 'কেরাণী-দিদিমণি'র মেয়ে তো, আবার ক্লাসে মাঝেমধ্যে ফার্স্টও হয়৷ তাই তেমন ইচ্ছে না থাকলেও মাঝেমাঝে ওকে ওর পছন্দমত দলেই নিয়ে নেয় অন্যরা৷
ফেলির বাবা খুব আদর করে ওর 'ফুলেশ্বরী' নামটা রেখেছিল৷ তা বাবা হঠাত্ টুপ করে মরে যেতেই ওর ফেলি নামটাই ঘরে বাইরে বেশী চল হয়ে গেল৷ ফেলিরা চলে এলো মামাবাড়ীর একতলার একদিকে৷ ধীমানের মাত্র দুই বছর বয়সেই মারা গেল বাবা, ফেলির তখন আট৷ এই আট বিয়োগ দুই সমান সমান ছয় বছর ধরে ফেলি একা একা ভাল ভাল সব খাবার খেয়েছে, অথচ দ্যাখো এর তো কোন দরকারই ছিল না৷ ফেলির তো দু বচ্ছর পেলেই হত৷ অথচ ওর ভাই ধীমান যদি আগে জন্মাত, তাহলে তো বাবাকেও বেশীদিন পেত আর পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়াও ভাল করে পেত৷ফেলি অবশ্য অতশত বোঝে না, 'পুষ্টিকর খাবার' মানে আপেল, দুধে ডিম গোলা, এইসব খেতে ওর যাচ্ছেতাই লাগে৷ এখন ভাগ্যিস আর খেতে হয় না৷ তবে দিদুর মুখে, মার মুখে বারবার শুনেশুনে ও-ও বিশ্বাস করে ওর আসলে পরে জন্মানোই উচিত্ ছিল৷কিন্তু তার জন্য ওর কী করা উচিত্ ছিল, সেইটেই ঠিক করে বুঝতে পারে না৷কিন্তু সেইসব পুষ্টিকর খাবারটাবার খেয়েও ফেলি জোরে দৌড়াতে পারে না কেন যে!
ক্লাসে ফাইভে উঠতেই যেই না ফেলি বড় হয়ে গেল আর অমনি দিদু ওর বিকেলে খেলতে যাওয়াটা বন্ধ করে দিল৷ এইবার ফেলি করে কি সারাদিন? ও খেলতে যায় না বলে ওকে রাস্তায় দেখলেও টুম্পা, মিনি, ইলারা কেউ কথা বলে না৷ ফেলি হাসলে ওরা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকায়৷ ফেলিরও অমনি একটু একটু রাগ হয় আর ও-ও একদম অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে৷ আর কোনোদিন ওদের দিকে তাকাবে না, তাকাবেই না৷ কথা বলতে এলেও বলবে না৷ সারা বিকেল ফেলি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখল কদিন, ওর সাথে কেউ কথা বলল না৷ তারপর পাড়ার ছেলেরা ঐ মাঠটায় বলখেলা শুরু করতেই ওরা সব শুভ্রাদের উঠোনে খেলতে যেতে লাগল৷ ফেলিদের বাড়ীও মস্ত উঠোন আছে, তাই শুভ্রাকে ওদের বাড়ী খেলতে আসতে বলল৷ কেউ এল না অবশ্য৷
ফেলি একতলার বারান্দায় বসে থাকে সারা বিকেল -----
ফেলি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে সারা বিকেল ----
ফেলি ছাদে ঘুরে বেড়ায় সারা বিকেল --------
দুপুরে স্কুলের দেওয়া বাড়ীর কাজ শেষ করার পর ফেলি আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার মাঝের ঘরে গিয়ে ঢোকে৷ ঘরটা মাঝখানে হওয়ায় হাওয়া টাওয়া তেমন আসে না, আবার এদিকে পাখাও নেই, ফলে ঐ ঘরে দুপুরে কেউ থাকে না৷ এদিকে জানলার ওপরের তাকে ভর্তি ভর্তি বই৷ ফেলি আস্তে আস্তে দেবদেউল নামে একটা মোটকা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে৷
ছোপ্পিপি এলে ফেলি ভারী খুশী হয়৷ কত রকমের বই আনে ছোপ্পিপি, ফেলির জন্য 'নবপত্রিকা', 'ইন্দ্রনীল', পুরবী', 'তপোবন', 'বাদশাহী আংটি'; ধীমানের জন্য চাঁদমামা, 'বাবুইবাসা বোর্ডিং', পাপুর বই, এমনকি মা'র জন্যও 'প্রসাদ', 'উল্টোরথ', 'বাতিঘর', 'বকুলকথা'৷ ফেলি সবগুলোই পড়ে ফেলে, মা'র বইগুলো নাকি বড়দের বই, ওদের এখন পড়তে নেই, তাই ফেলি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে নেয় ওগুলো৷ এই ব্যপারটা ও বোঝে না, 'বড়' হয়ে গেছে বলে ওকে আর খেলতে যেতে দিল না দিদু সেই তিন বচ্ছর আগে থেকে, অথচ এখনও এই বইগুলো ও পড়তে পারবে না৷ কেন, ও কী ধীমানের মত ছোট্ট? এই তিন বছরে তো ও আরও অনেক বড় হয়ে গেছে৷ ওর এখন আর সারা বিকেল মন খারাপ লাগে না, হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না৷ টুম্পা মিনিদের দিকে ও-ই এখন আর তাকায় না, ওরা তাকায় কিনা জানেও না৷
আট, নয়, দশ্, এগারো, বারো করে বছর গড়িয়ে গড়িয়ে যায় আর ফেলি আস্তে আস্তে ফুলেশ্বরী বা ফুলি হয়ে ওঠে৷ লেখাপড়া শেষ করে বেশ ভাল একটা চাকরী পেয়ে যাওয়ার প্রথম কয় বছর ফেলি আর বইটই পড়ার তেমন সময় পেত না, যদিও তখন কিনত প্রচুর৷ ওদের ছোট্ট মফস্বল থেকে কাছের শহরে যেতে আসতে দুই ক্ষেপে দুই দুই করে চার ঘন্টা সময় লাগত৷ ফিসেও প্রায়ই দেরী হত, ফলে ছুটির দিন ছাড়া আর বই পড়া হত না৷ ধীমানও চাকরী শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই ফেলি দেখল ও আর বাড়ীতে আঁটছে না৷ এরমধ্যে ওরা মামাবাড়ী ছেড়ে মা'র বানানো বাড়ীতে চলে এসেছে৷ মা'র বাড়ীটা যে বড্ড ছোট, ধীমানএরই জায়গা কম পড়ে, ফেলি আর কেমন করে আঁটবে ওখানে৷ বাড়ী ফেলিকে ছাড়তেই হত, এমনি এমনিই কাছাকাছি অন্য কোথায়ও থাকলে মা ও অন্য আত্মীয়স্বজনরা ভারী রাগ করত৷ ফেলি তাই কাজের সিঁড়ি বেয়ে ওঠে আর ওঠে৷ প্রথমে ভিন্ন রাজ্য, পরে ভিন্ন দেশ, উঠতেই থাকে৷ সিঁড়িটা যতদিন না ওকে একটা বড়সড় আলোহাওয়াখেলা আটতলার বারান্দায় পৌঁছে দেয়৷ ওর কেনা কাপড়চোপড়, বইপত্রগুলো বড্ড জায়গা জুড়ে থাকে বলে মা ভারী বিরক্ত হত, ফেলি তাই বাড়ী আসলেই বলে যেত কাপড়চোপড়গুলো ভারত সেবাশ্রমে কি অন্য কোথায়ও দিয়ে দিক মা, কিন্তু বইগুলো একটু কষ্ট করে আর ক'টা বছর রাখে যেন৷ ফেলি নিজের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করে ঠিক নিয়ে যাবে সব, খালি করে দেবে জায়গা৷ কিছু কিছু বই নিয়েও যেত৷
একযুগ পরে ফেলি আবার ফেরত আসে কাছের শহরে বদলী নিয়ে৷ মা'র শরীর খারাপ, হার্টের সমস্যা৷ একা ধীমানের ওপরে চাপ পড়ে বলে মা প্রায়ই ফোনে অনুযোগ করত৷ কাছের শহরে আসায় মা'ও খুশী হয়৷ অফিসের কাছেই ফেলি বাড়ী নেয়৷ বড়মামী, মেজমামীর সাথে মা গল্প করে, এখন তো আর দুই তিন ঘন্টা যাতায়াতের জন্য নষ্ট করা ফুলি'র পক্ষে সম্ভব নয়৷ সব্বাই ওকে ফুলি বলে ডাকে এখন, শুধু ফেলি নিজেই নিজেকে ঠিক 'ফুলি' বলে ভেবে উঠতে পারে না৷
এতদিন বিভিন্ন জায়গায় বইগুলো ডাফল ব্যাগে করে নিয়ে ঘুরত ফেলি৷ একটা, দুটো, তিনটে, চারটে ডাফল ব্যাগ৷ এবার একটা দুটো করে বুককেস কিনে সাজিয়ে সাজিয়ে রাখে৷ এখন জীবনযাপন অনেক আরামদায়ক হয়ে যাওয়ায় বই পড়ার বেশ খানিকটা সময় পায়৷ ফেলি ভাবে এইবার আস্তে আস্তে মা'র বাড়ীতে জায়গা খালি করে দিতে হবে৷ প্রথমেই মনে পড়ে ছোপ্পিপির দেওয়া দেব সাহিত্য কুটীরের সেই অপূর্ব পুজোবার্ষিকীগুলোর কথা৷ মা প্রায়ই অভিযোগ করত, ওগুলো নাকি ছিঁড়ে যাচ্ছে, এবারে পুরানো কাগজের সাথে বিক্রী করে দিতে হবে৷ ফেলি বলত ও নিয়ে এসে ঠিক করে বাঁধিয়ে নেবে৷ ওর সেই একলা বিকেলের সঙ্গীদের এবার ও নিজের কাছে নিয়ে আসবে৷ যত্ন করে সাজিয়ে রাখবে৷
ফেলি আনতে যায় একদিন৷ ও যাবে বলে মা নারকোলের নাড়ু, ক্ষীরের বরফি বানিয়ে রেখেছে৷ ওদের ছোট্ট বাড়ীতে জায়গা বাড়ানোর জন্য ধীমানের ঘরে একদিকের দেওয়ালজোড়া সিমেন্টের তাক, দরজার উপরে৷ খাওয়াদাওয়ার পরে ফেলি ছোট মইতে চড়ে বইয়ের তাক ঘাঁটে৷ সামনের বইগুলো সরিয়ে পুজোবার্ষিকীগুলো বের করার চেষ্টা করে৷ খান চারেক পায়, বাকীগুলো আর পায় না৷ খুঁজে পায় না 'বাংলার ডাকাত' কিম্বা 'ভোম্বোল সর্দার'ও৷ অবাক হয়ে মা'কে ডাকে ফেলি৷ মা'ও কিছু বলতে পারে না৷ বলে 'দূর ওসব বই ছিলই না'৷ ছিল না মানে? ফেলি যে ঐ বইগুলোর প্রত্যেকটা পাতা মনে করতে পারে৷ নেই --- নেই ---- নেইই---- বইগুলো একদম নেই হয়ে গেছে৷ ফেলি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে 'সমস্ত বইগুলো বিক্রী করে দিলে মা? আমি যে বলেছিলাম কয়েক বছর রাখো, আমি এসে সব নিয়ে যাব'৷ মা খুব বিরক্ত হয়ে বলে 'বাজে কথা বলিস না ফুলি, কই আমি তো মনেই করতে পারছি না অত অত বই কখনো বিক্রী করা হয়েছে৷ তোর ভুল হচ্ছে ঐসব বই কক্ষণো ছিলই না আমাদের বাড়ীতে৷ ধীমানকে জিজ্ঞাসা করে দেখ'৷
রাত সাড়ে বারোটা বাজে৷ ফেলি চুপ করে বারান্দায় বসে আছে, কোলে চারখানা দেবসাহিত্য কুটীরের পুজোবার্ষিকী৷ ওর সেই একলা বিকেলগুলো, মনখারাপ মাখা সন্ধ্যেগুলো একসাথে চারদিক থেকে চেপে ধরছে ওকে৷ সেইসব পুরবী, তপোবন, প্রভাতী, শারদীয়া, বেণুবীণা, বোধন, হলদে পাখির পালক, টংলিং, ছোটদের বুক অব নলেজ, ভোম্বোল সর্দার, চুক আর গেক, নতুন ছেলে নটবর, একটাও নেই! কোনোদিন ছিলই না!? ও-ও কি তাহলে সেই গনশার মত একা লাগত, মন খারাপ লাগত বলে, ভয় করত বলে এই বইগুলো মিছামিছি মনে মনে বানিয়েছিল? যা: তা কি করে হবে? ঐ যে পুরবীতে বগলামামার গল্পটার শেষ পাতাটার কোণা ছিঁড়ে গেছিল --- অমরেশমামা জিন্দাবাদের ছয় পাতায় একটু আলুদ্দমের ঝোল লেগেছিল ---- আর শারদীয়া'য় পল্টু-কানু-বাঞ্ছু'র গল্পটার পাতার মাঝখানগুলো অল্প করে উইয়ে খেয়ে নিয়েছিল৷ ও যে এতবার করে বলেছিল ও একটু সুযোগ পেলেই বইগুলো নিজের কাছে নিয়ে আসবে! কেউ কি বিশ্বাস করল না, ভাবল বুঝি ও এমনি করেই ওদের জায়গা জুড়ে রেখে দেবে৷ ফেলি এতদিন ওদের খোঁজ নেয় নি, যত্ন করে নি বলে ওর বইগুলো এমন করে হারিয়ে গেল, চুপি চুপি একা একা!
ফেলি নি:সংশয় হয়ে যায় ও ফেলিই আছে, ফুলি হয় নি কোনোদিনই৷
eto anekaTaa tomaar galpo!!! khub mon khaaraap haye gel. er shilpaguN bichaar karaar xamataa aamaar nei. shudhu khub khub man khaaraap hal, aamaar nijer chhoTo belaar haariye Jaaoyaa baigulor kathaa mane parhachhe. kaman parhechhe bhombal sardaar, chuk aar gek, kichhu deb saahityo kuTirer pUjaa baarshhikee.
ReplyDeletetabe oi boi gulo haariye Jaabaar janye aamii daayee chhilaam.
galpoTa shesh holeo maajhe kichhu ekta tumi boloni.. seta bolo.. apexaay achhi.. abar shuru theke parhbo, tar age maajhe je shunyasthaanTa anubhab kara jachchhe kintu dekha jachchhe naa seta pUrNa karo jaldi.. most probably eta tomar mathatei achhe :-)
ReplyDeletebaaki.. khub bhalo lagchhe eta anya kibhabe balaa jaay seta bhebe niye parer galpoTar janya tola roilo..ar.. ei nostalgia, ei tomar kalame nijeke chhu`nye neoyar khushiTa 13r porer janya tola roilo..
jadi roj tagada na chao to sajiye dao phelir monbarandaTa thikthak..
খুব সুন্দর! মন খারাপ হয়ে গেলো -- আমারো অনেক অনেক হারিয়ে যাওয়া বইগুলোর গল্প মনে পড়ে গেলো।
ReplyDeleteদেবযানী
bhaalo hayechhe khub. man khaaraap karaa.....anekabaar dekhaa, shonaa, balaa kathaagulo...tabu natun kare man khaaraap halo. aamaader sabaar chhoTobelaatei haariye Jaaoyaa, baa naa thaakaa baiyer galpa jame aachhe. seisab kathaa mane parhe gela.
ReplyDeleteparer lekhaar apexaay railaam.
kothay hariye gelo--sob to moner modhye sposto korei royechhe--bairer bojhaa na bariye moner manikothay tule rakhai to bhalo---jokhon ichchhe narachara kora jay, nijer moton kore---boro abhimani lekha, bishhad-madhur o--anekxon bhabay , anekxon resh roye jay----felir----
ReplyDeleteদারুন লিখেছেন
ReplyDelete