খোঁজাখুঁজি

Saturday, July 31, 2010

মন্দাদিনের আঁকিবুকি


--
আমার একটা লালমাটির রাস্তা আছে ৷ স্বপ্নে৷ সেই রাস্তাটা সামনে বেশ সোজা৷ যত দূরে যেতে থাকে, ততই অ্যাঁকাব্যাঁকা হয়ে ঝাপসা হয়ে যায়৷ অনেক দূরে , যেখানে আকাশ নীলচে লাল আর মাটিটা সবজে লাল, সেখানে গিয়ে এই রাস্তাটা এঁকেবেঁকে হঠাত্ আকাশে উঠে যায়৷ ঘুম না এলে চোখ বুঁজে এই রাস্তাটাকে আমি দেখি ৷ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি৷ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখি, কিম্বা দেখি না, ঠিক মনে থাকে না৷


আমার স্বপ্নে আগে অনেক পুকুরও ছিল৷ ছোটবেলায় একসময় আমি শহর থেকে মফস্বলের আত্মীয়বাড়ীতে গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পুকুর দেখে বেড়াতাম৷ টলটলে পুকুর, পানা পুকুর, সাঁতার কাটার , চান করার, কাপড় কাচার পুকুর কিম্বা গম্ভীরমত দেখতে, খাবার জলের পুকুর৷ সেগুলো আজকাল আর নেই৷ আমি যখন বেশ বড় হয়ে চাকরী শুরু করি, তখন চারদিকে হঠাত্ "সমৃদ্ধি'র পালে হাওয়া লাগে৷ চারিদিকে সবকিছু ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে৷ ছোট বাড়ীগুলো বড় হয়ে যায়, বড়গুলো ভেঙেচুরে 'হাউসিং কমপ্লেক্'স হয়ে যায়৷ রাস্তাগুলো চওড়া হয়৷ আর এরা সবাই মিলে পুকুরগুলো চুষে খেয়ে ফেলে৷ আমার স্বপ্ন থেকে তাই পুকুরগুলো উবে গেছে৷ তার বদলে আমি আজকাল মাঝেমাঝে খালিবাড়ীর স্বপ্ন দেখি৷ অর্ধেক তৈরী হওয়া কংক্রীটের খাঁচার স্বপ্ন৷


আমাদের এই শহরটাতেও একসময় অনেক বাড়ী তৈরী হতে শুরু করেছিল৷ তারপর তারা সবাই আর ঠিকঠাক তৈরী হয়ে উঠতে পারল না৷ কারণ হিসাবে শোনা গেল, পৃথিবীজোড়া নাকি সাংঘাতিক মন্দা এসেছে৷ তাই লোকে আর বাড়ী কিনছে না৷ শুধু কিনছে না তাই নয়, লোকে নাকি বাড়ীর জন্য নেওয়া ধার শোধও করতে পারছে না৷ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে৷


অথচ এই একবছর আগেও এসব কিচ্ছু ছিল না৷ চারিদিকে বেশ উথলে পড়া ভাব ছিল৷



--
গতবছর দোলের সময় হঠাত্ শোনা গেল শহরের একটা বড় কোম্পানি তাদের চেন্নাই শাখা থেকে ২৫০ জনকে ছাঁটাই করেছে৷ খবরের কাগজের সাংবাদিক যখন কোম্পানির প্রতিনিধিকে কারণ জিআসা করলেন, তিনি জানালেন এটি গুজব এবং গুজবের হ্যাঁ-না সম্পর্কে মন্তব্য করতে তিনি অপারগ৷ ফলে গুজব আরও ছড়াতে লাগল হু হু করে৷ জানা গেল আমেরিকায় জেনারেল মোটরসের অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় এদিকে কাজ খুব কমে গেছে, তাই ছাঁটাই৷ এদিকে সেই কোম্পানির কর্মীদের কাছে গুজবে কান বা চোখ না দেবার আবেদন জানিয়ে মেল এলো৷ কর্মীদের দক্ষতা সম্পর্কে নানাবিধ বাণীও ছিল তাতে৷


সেই কর্মীদের তারপর কি হল, তা প্রায় কেউই জানে না দেখা গেল৷ একমাসের মধ্যে সবাই ভুলেও গেল ঘটনাটা৷


শুধু মেলবক্সে চাকরীর খবর আসা কমে যেতে লাগল৷
শুধু কাগজে খবর আসতে লাগল বাড়ীর দাম কমেছে৷
শুধু কাগজে আরও বেশী বেশী করে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের নামে ণগ্রহীতাদের বাড়ীতে গুণ্ডা পাঠানোর অভিযোগ আসতে লাগল৷



--
শালিনী নতুন চাকরীটা পেয়েছে গতবছর মে মাসে৷ একটা এজেন্সিতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরী৷ ওদের এজেন্সি গোটাকয় শপিংমলে সিকিউরিটি গার্ডের যোগান দেয়৷ শালিনীর কাজ একটি নির্দিষ্ট শপিংমলের গেটে দাঁড়িয়ে আগত মহিলা ক্রেতাদের ব্যাগ তল্লাসী করা৷ হ্যাঁ শুরুতে শুধুই ব্যাগ তল্লাসী করতে হত৷ দুই সাইজ বড় একটা নীলচে ছাই রঙের শার্ট আর নেভী ব্লু ট্রাউজার পরে শালিনী যেদিন প্রথম কাজে যোগ দিতে আসে, সেদিন সে খুবই খুশী, উত্তেজিত ও কিঞ্চিত্ ভীত ছিল৷ ঐ চাকরীর প্রথমদিন অধিকাংশ লোকেরই যা হয় আর কি! ওকে তালিম দেওয়ার সময় এজেন্সি থেকে পইপই করে বলে দিয়েছিল শার্টের সাইজ যেন অবশ্যই ওর মাপের চেয়ে দুই সাইজ বড় হয়৷ কারণ ওকে গেটে দাঁড়াতে হবে৷ আর ও তো মেয়ে; কাজেই ওঁরা কোনোরকম ঝামেলা বা বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করার মত কিছু চান না৷


শালিনীর দিনে ১২ ঘন্টা কাটে গেটে দাঁড়িয়ে মহিলাদের ব্যাগ খুলে উঁকি দিয়ে৷ প্রথমে হাতের মেটাল ডিটেক্টার দিয়ে আলতো করে ব্যাগের ওপরে বুলিয়ে নিয়ে প্রার্থিত 'ট্যাঁ' শুনলেই ব্যাগের চেইন বা ক্লাচ খুলে ভেতরে উঁকি দেওয়া৷ একেকজনের ব্যাগ বেশ ছোট্ট এবং ছিমছাম৷ ভেতরে বেশী খাপখোপ নেই৷ আবার একেকজনের ব্যাগে এত চেইন আর এত বিভিন্ন সাইজের কুঠুরী; যে প্রত্যেকটায় উঁকি দিতে দিতে গেটের সামনে মহিলাদের লাইন পড়ে যেত; সকলেই ওর অকর্মণ্যতায় ও ধীরগতিতে বিরক্ত৷ অনেকেই সে নিয়ে যথেষ্ট সরবও৷ একে তো অনভ্যস্ত হাত, অপরিচিত লোকের ব্যাগে উঁকি দেওয়ার সংকোচ, তার সাথে ছুটে আসা মন্তব্যের ধারে ছিন্নভিন্ন হতে হতে শালিনী স্বপ্ন দেখত চীফ গার্ড হয়ে যাওয়ার৷ তখন আর ওকে গেটে দাঁড়াতে হবে না, বরং ও-ই অন্য গার্ডদের ওপরে খবরদারী করবে৷



--
রাকেশ গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুরানো ভেস্পাটা বিক্রি করে একটা ইউনিকর্ণ কিনল৷ গত ২ বছর উদয়াস্ত খেটে ও অন্তত ২৫০০ লোকের হোমলোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ ও যে প্রাইভেট ব্যাঙ্কটির হয়ে কাজ্ করে, তারা কমিশান ভালই দেয়৷ এজেন্সি থেকে প্রাপ্ত মাসমাইনে তো আছেই৷ তাতেই আস্তে আস্তে সংসারের চাহিদা মিটিয়েও একটু একটু করে টাকা জমিয়ে এটা কিনতে পারল৷ ভাগ্যিস বাবা বাড়ীটা বানিয়ে রেখে গেছিলেন, তাই অন্তত মাথার ওপরে ছাদ নিয়ে ওকে ভাবতে হবে না৷ "সবই গণেশজীর কৃপা" - ভাবে রাকেশ৷ এবারে গণেশ পুজোর সময়ে "মহামন্ডলী"তেও তাই হাজার কুড়ি চাঁদা দিয়েছে৷ ওর ইচ্ছে ছিল একটা গাড়িই কেনার৷ মারুতী স্যুইফট পছন্দ, ওরও পুনমেরও৷ কিন্তু গত মাস দুই ধরে হোমলোনের জন্য লোকে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না৷ পুনমও বলল একটু রয়েসয়ে চলাই ভাল৷ রাকেশ তাই আপাতত ইউনিকর্ণই নিয়ে নিল৷ পরে দেখা যাবে খনে৷


অক্টোবরে হঠাত্ই একদিন রাকেশকে ফোন করে এক ভদ্রলোক ভয়ঙ্কর চেঁচামেচি করলেন৷ রাকেশই বছর দুই আগে তাঁর লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল৷ প্রায় 54 লক্ষ টাকার লোন৷ মস্ত বড় বাংলো, সঙ্গে আবার একটি প্রাইভেট লেক আছে, মাছ ধরার জন্য৷ হাইওয়ের ধারেপাশেই৷ ফলে দামও বেশী৷ রাকেশ প্রথমে ভদ্রলোককে মনে করতেই পারে নি৷ পরে উনি বেশ খানিক চেঁচামেচি করার পর ওর মনে পড়ে৷ উনি নাকি গত 4 মাস ধরে ইএমাঅই দিতে পারছেন না, তাই ব্যাঙ্ক তাঁকে কড়া করে নোটিশ দিয়েছে৷ তিনি সময় চেয়ে আবেদন করলে কিছু লোক ফোন করে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে৷ রাকেশ যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারে৷ রাকেশ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে যে ব্যাঙ্কের সাথে ওর যোগাযোগ শুধু ঐ যোগাড় করে দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ৷ ও ঐ ব্যাঙ্কে চাকরীও করেনা, আর কেউ লোন পেয়ে যাওয়ার পর সে সম্পর্কে আর কিছু জানেও না৷ কিন্তু ভদ্রলোক সেসব শুনলেও ঠিক বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না৷ উনি চেঁচামেচি করেন, অনুনয় বিনয় করেন এবং শেষমেষ কেঁদে ফেলেন৷ রাকেশের হঠাত্ কিরকম ভয় করতে থাকে৷ ও ফোনটা কেটে দেয়৷ ঘন্টাখানেক স্যুইচ অফ করে রেখে দেয়৷


সেই রাতে রাকেশের ভাল করে ঘুম হয় না৷



--
সুভাষ দেশমুখ আগে একটি অর্ডার সাপ্লায়ার কোম্পানিতে কাজ করতেন৷ আগে মানে ১১ বছর আগে৷ তখন খালি ভারী ভারী ব্যাগ নিয়ে এখানে সেখানে যেতে হত৷ দিন নেই, রাত নেই, যখনই বলবে, যেখানেই বলবে সেখানেই যাও৷ সুভাষ তিতিবিরক্ত হয়ে কোনোমতে সময় করে ড্রাইভিং শেখেন৷ এরপর চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভিং স্কুলে ট্রেনার হিসাবে যোগ দেন৷ সেই থেকে আছেন সাই মোটর ড্রাইভিং স্কুলে৷ ভোর সাড়ে ছটা , সাতটা থেকে বেলা বারোটা অবধি ডিউটি৷ তারপর আবার বেলা তিনটে থেকে সন্ধ্যে ছটা অবধি৷ সপ্তাহে ছ'দিন৷ রবিবারে উনি প্রাইভেটে ট্রেনিং দেন৷ ঘন্টায় ২০০ টাকা করে নেন৷ ড্রাইভিং স্কুলের বেতন আর প্রাইভেট সেশনের টাকা মিলিয়ে বেশ হেসেখেলেই চলে যায়৷ তবে এই শহরটা বাপু বড্ড বড়লোকের শহর৷ নাহলে আরও কিছু বাঁচত৷ আজকাল উনি প্রায়ই ভাবেন ট্রেনারের চাকরী ছেড়ে দিয়ে কোন ট্র্যাভেল এজেন্সীর হয়ে ড্রাইভারের চাকরী নেবেন৷ ঐ বিভিন্ন কোম্পানি বা কলসেন্টারের কাজে প্রচুর গাড়ী লাগে, আর তার জন্য চাই প্রচুর ড্রাইভার৷ গাঁও থেকে কত ছেলে এসে এই করে রীতিমত দাঁড়িয়ে গেল৷


টাকা জমিয়ে গ্রামে বাইশ বিঘে জমি কিনেছেন, সয়াবিনের চাষ হয়৷ বৌ দেখাশোনা করে৷ ছেলে মেয়েগুলোকে স্কুলে দিয়েছেন ৷ দুই ছেলে এক মেয়ে৷ মেয়েটির ১৪ হলেই বিয়ে দেবেন বলে ভেবে রেখেছেন৷ মেয়েদের বেশীদিন ঘরে রাখা ঠিক না৷ দিনকাল খারাপ৷ আজকাল অবশ্য মাঝেমাঝেই মেয়ের ১৪য় বিয়ে দেওয়া নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে যান৷ ওঁর কাছে গাড়ী চালানো শিখতে আসা ম্যাডামদের দেখে৷ এদের সব্বাইকে "ম্যাডাম' বলে ডাকতে হয়, নাহলে "বদ্তমিজ্' বলে মালিকের কাছে কমপ্লেইন আসে৷ এরা কেমন অবলীলায় ঘুরেফিরে বেড়ায়৷ ফরফরিয়ে ইংরিজি বলে৷ একহাতে চুল ঠিক করতে করতে, আর এক হাতের আঙুলে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে টকাস টকাস করে শিখে নেয় ক্লাচ, গীয়ার আর এক্সিলারেটরের ঘাঁতঘোঁত৷ মাঝেমাঝে উনি মনেমনে ওদের জায়গায় নিজের মেয়েটাকে কল্পনা করেন; ভাবেন ও যতদূর পড়তে চায় -- পড়াবেন, তারপর ও-ও চাকরী করবে, আবার সঙ্গেসঙ্গেই মন থেকে জোর করে সরিয়ে দেন ওসব ভাবনা৷ আরে গরীবের ঘোড়ারোগ হলে কি চলে নাকি? তাছাড়া এখনই ওঁর প্রায় ৪৪ বছর বয়স হতে চলল৷ বয়স বেড়ে যাচ্ছে বড্ড তাড়াতাড়ি৷ বরং মন দিয়ে খেপ খাটলে কটা টাকা আসে৷ তবু মাঝে ঐ ম্যাডামদের জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হয় কোথায় পেলেন তাঁরা এই জাদুকাঠি? কেমন করে পেলেন?


না: দেশমুখ ছেড়েই দেবেন এই চাকরীটা৷ ড্রাইভারের চাকরীই নেবেন৷



--
রুচা আর অনুরাগের বিয়ে হয়েছে সাত মাস হল৷ দুজনেই আইটিতে আছে৷ রুচার কোম্পানিটার বেশ নামডাক আছে ভারতের বাজারে৷ অনুরাগ আবার বরাবরই ছবিটবি আঁকে, প্রোগ্রামিঙের চেয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইনেই আগ্রহ বেশী৷ পাশ করার পর ও তাই ঢুকেছে ভিডিও গেমস ডিজাইন করার সংস্থায়৷ ওদের কোম্পানির বানানো ভিডিও গেমসগুলো হু-হু করে বিক্রি হয় হংকং, তাইওয়ান আর জাপানের বিভিন্ন শহরে৷ মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়া থেকেও কিছু অর্ডার পায় ওরা৷ পয়সাকড়ি মন্দ পায় না৷ বিশেষ করে অ্যানুয়াল বোনাস তো গত বছর ভালই পেয়েছিল৷ সেই সাহসেই বিয়ে করা৷ অবশ্য রুচার মাইনে আর ইন্সেন্টিভ মিলিয়ে ওর প্রায় দ্বিগুণ৷ সেটাও একটা বড় ভরসার কথা বটে৷ এই শহরটায় সবকিছুই এত দামী যে মোটামুটি একটু হেসেখেলে বেঁচে থাকতে গেলেও দুজনের জন্য বেশ ভালই টাকা দরকার হয়৷


রুচার এক ভাই অবশ্য মানসিক প্রতিবন্ধি৷ জড়ভরতের মত সারাদিন বসে থাকে আর মুখ দিয়ে অঝোরে লালা ঝরে যায়৷ কিচ্ছু দেখে না৷ কিচ্ছু শোনে না৷ কিচ্ছু বোঝে না৷ ওর খরচখরচা রুচাই চালায়৷ বছরকার ইনসেন্টিভের ভরসাটা না থাকলে রুচা হয়ত আরো ২-৩ বছর পরে বিয়ে করত৷ এর মধ্যে একবার অনসাইট ঘুরে আসতে পারলে বড় ভাল হত৷ কিন্তু ওর মাত্রই ২ বছরের অভিজ্ঞতা৷ আর ওদের প্রোজেক্টে রোটেশান সিস্টেম নেই৷ রুচা অনুরাগের সাথে প্ল্যান করে কিভাবে রিলিজ নিয়ে অন্য একটা প্রোজেক্টে যাবে, যেখানে "অনসাইট" যাওয়ার সুযোগ আছে৷ কতদিনের জন্য যাবে, তাই নিয়ে দুজনের মধ্যে অল্পস্বল্প মন কষাকষিও হয়ে যায়৷ রুচার ইচ্ছে অন্তত একবছর৷ অনুরাগ বলে ছয়মাসই তো যথেষ্ট৷ রুচা বলে এখন তো ডলারের রেট সেই ৩৯-৪১ এই ঘোরাফেরা করছে৷ এখন কি আর আগের মত সেই দিন আছে যে ডলারের দাম হবে ৪৯ আর কনভার্ট করালেই ব্যাঙ্কে লাখে লাখে টাকা জমা পড়ে যাবে! কিন্তু সেসব তো পরের কথা৷ যেতে পারলে তবে না৷ অনসাইট মানে অবশ্য আমেরিকা কিম্বা ইউ কে কিম্বা ইউরোপের কোন "উন্নত" দেশ৷ যেখানে কাজ করে আসলে হাতে বেশ কিছু জমে আর কি৷ এখন আর অনসাইট-অফশোর মডেলে অনসাইটে বেশী লোক রাখা হয় না৷ অথচ এই কয়েক বছর আগেও ৭০-৩০ অনুপাতে লোক থাকত৷ পরে কমে হল ৮০-২০ অনুপাত৷ এখন লোকে চাইছে ৯০-১০ কিম্বা ৯৫-৫ এ কাজ করাতে৷ রুচা ভাবে আর ক'বছর আগে যদি জন্মাত!


ডিসেম্বারের শেষদিকে অনুরাগ একটু চুপচাপ হয়ে গেল৷ কথা প্রায় বলেই না৷ রুচা অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারল ওদের কোম্পানির অবস্থা নাকি খুব খারাপ৷ যাদের কাছে কন্ট্র্যাক্ট পেত, তারা আর কিনতে চাইছে না৷ লোকের হাতে পয়সা নেই, তাই কেউ খরচা করে ভিডিও গেমস কিনছে না৷ ওরা নাকি অক্টোবরের শেষ থেকেই কোন কাজ করছে না৷ রুচা ভয় পায়৷ সত্যি ভয় পায়৷ বাজারে মন্দার খবর ওদের অজানা নয়৷ ওদের বিজনেস ইউনিটের ওপেন হাউসে বি ইউ হেড বলেই দিয়েছেন কোম্পানি খরচ কমাবার জন্য প্রচুর চিন্তাভাবনা করছে৷ অনুরাগ অবশ্য ওকে ভরসা দিয়ে বলে যে অর্থনীতির অবসাদ যত বাড়ে, লোকে নাকি তত বেশী করে ভিডিও গেমস পার্লারে যায়, নীলছবি দেখে ইত্যাদি৷ এ নিয়ে নাকি অনেক ভাল ভাল লেখাপত্রও আছে৷ রুচা খুব একটা ভরসা পায় কিনা বোঝা যায় না, তবে এই নিয়ে আর বেশী কথা বাড়ায় না৷



--
গণেশ পুজো শেষ হয়ে যেই দুর্গাপূজা আসি আসি করছে, সেইসময়ই আমরা জানতে পারি যে দুনিয়াজোড়া সাংঘাতিক মন্দা এসে গেছে৷ লেম্যান ব্রাদার্সের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশের পরেও আমরা প্রায় নিশ্চিন্ত ছিলাম যে এসব তো আমেরিকার সমস্যা৷ আর সাধারণভাবে যে ধারণাটা আছে যে, আমেরিকা ইউরোপের লোকজন তো গরীব হয়ে গেলেও, চাকরী চলে গেলেও, আমাদের থেকে অনেক বেশী অবস্থাপন্ন থেকে যায়৷ সেই বিশ্বাস থেকেই অতুল আমাকে বলে "আরে দুর দুর বড়জোর ওরা দুটো তিনটে গাড়ীর জায়গায় বাড়ীপিছু একটা করে গাড়ী রাখবে, একটু কম কম বেড়াতে যাবে ----- আমাদের আর কি! একটা ক্লায়েন্ট গেলে আরেকটা প্রোজেক্টে চলে যাব৷ আর নাহলে অন্য কোম্পানিতে যেতে হবে আর কি! 'হামকো কুছ অসর নেহি পড়েগা ইয়ার' ৷


কিন্তু না, আমরাও যে এর থেকে রেহাই পাব না, তা বোঝা গেল ডিসেম্বারের শেষদিকেই৷ হঠাত্ই মেলবক্সে আসা বিভিন্ন চাকরীর অফার একদম কমে প্রায় শূন্য হয়ে গেল৷ এদিকে চাকরীপ্রার্থীর সংখ্যা বেশ চোখে পড়ার মত বেড়ে গেল৷ চেনাশোনা, বিভিন্ন পুরানো কোম্পানির লোকজন জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন কোথায়ও কোন সুযোগ আছে কিনা৷ সবাই ভয়ে কাঁটা, সব কোম্পানিতেই নাকি খুব খারাপ অবস্থা, প্রোজেক্ট টোজেক্ট বিশেষ নেই৷ এদিকে কাগজেপত্রে সব কোম্পানিই প্রফিট পোস্ট করছে৷ একটা অতিবিখ্যাত বড়সড় কোম্পানি নাকি অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের কর্মীসংখ্যা ৬% কমিয়েছে৷ ভারতে এই সবই হয় খুব চুপিচুপি৷ কেউ বিশেষ কিছু জানতে টানতে পারে না, শুধু নি:শব্দে কিছু লোক হঠাত্ কোন একটা কোম্পানিতে 'নেই' হয়ে যায়৷ আপনি যদি তাকে চেনেন, জানেন, তাহলে হয়ত জানলেও জানতে পারেন৷



--
জর্জ অ্যালেক্স এই টেলেকম বিলিঙের সিস্টেমটায় কাজ করছেন প্রায় ২২ বছর৷ এর মধ্যে মালিকানা বদলালো বার দুই৷ শেষের বার তো শুধু বিলিং সিস্টেমটাই ধরে অন্য কোম্পানিকে বেচে দেওয়া হল৷ ওঁরা প্রায় জনা পঞ্চাশ লোক একরাতে অন্য কোম্পানির হাতে চলে গেলেন৷ এরা বিলিং কিনে নিয়েই আর্ধেক লোক রেখে বাকীদের ছাঁটাই করে দিল৷ আর ভারতের একটা কোম্পানিকে বেশীরভাগ কাজ 'আউটসোর্স' করে দিল৷ এই এক 'আউটসোর্স' হয়েছে! সব কোম্পানি একধার থেকে আউটসোর্স' করে চলেছে৷ 'আউটসোর্স' হাহ্! জর্জ বুঝে উঠতে পারেন না নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার একি অদ্ভুত খেলা চারিদিকে৷ সমস্ত কাজ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঐ চীনা আর ভারতীয়গুলোকে৷ আর এরা এত সস্তায় কাজ করেই বা কী করে? উনি ওদের অনেকভাবে শক্ত শক্ত সমস্যার মুখে ফেলে দিয়ে দেখেছেন ---- প্রচুর ভুলভাল করে, কিন্তু খুব অল্পদিনে শিখে যায়৷ উনি ১০ বছর ধরে যা শিখেছিলেন, এরা ২-৩ বছরেই তা শিখে যায়, আর কোম্পানি আরও কিছু কাজ ভারতে 'আউটসোর্স' করে দেয়৷


এই সবই জর্জ আমাকে বলেছিলেন জানুয়ারীর এক দুপুরে৷ ওঁর তখন মধ্যরাত পেরিয়েও একঘন্টা হয়ে গেছে৷ সেইদিন, যেদিন ওঁদের এক ভারতীয় সহকর্মীকে দুই সপ্তাহের নোটিশ দেওয়া হয়৷ মেসেঞ্জারে চ্যাট শুরু করে শেষপর্যন্ত ফোনে গড়ায়৷ ঘন্টা দেড়েক আমার সাথে কথা বলেন৷ আসলে নিজের সাথেই কথা বলছিলেন হয়ত৷ উনিই আমাকে জানান জয়রাজের চাকরী গেছে৷ মাসের শেষে তাকে চলে যেতে হবে৷ তারপরই উপরের কথাগুলো বলে যান৷ বলেন ওঁদের দেশের সমস্ত টাকাপয়সা আস্তে আস্তে ভারত আর চীনে চলে যাচ্ছে৷ প্রথমদিকে বেশ 'খোরাক' মনে হলেও একটু পরে একসময় স্পীকার অফ করে রিসিভারটা উঠিয়ে নিই৷ উনি এসব কিছুই টের পান না৷ আপন মনেই বলে চলেন -- আমি স্বভাবে যোদ্ধা, সারাজীবন যুদ্ধ করেছি অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে৷ কত ছেলেপুলেকে তৈরী করেছি---------- এই সিস্টেমের ইন অ্যান্ড আউট জানি আমি, একেকজনকে তৈরী করেছি; তারা ভাল অফার নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে কেউ কেউ বা শিখতেই পারেনি --- তাদের ফায়ার করা হয়েছে --- এরকম তো এখানে হয়ই; কেউ কিছু মনে করে না, তারা আবার অন্যত্র পেয়ে যায়৷ কিন্তু এবারে আমার ভয় করছে৷ আমি জিজ্ঞাসা করি ভয় কেন? বলেন - আমি চিরকাল জেনে এসেছি আমার ব্যাকাপ তৈরী করব --- তারপর অন্যত্র মুভ করে যাব --- কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার ব্যাকাপ তৈরী করে আমাকে সরে যেতে হবে৷ মুভ অন আর মুভ আউট শব্দদুটো নিয়ে অনেকক্ষণ খেলা করেন৷ আমি চুপ করে শুনতে থাকি৷ বলেন ---- আমি জানি তুমি তোমার টীম নিয়ে পুরো সিস্টেমটা বুঝে গেলেই আমি আউট হয়ে যাব৷ আমি জানি কথাটা ঠিক৷ সিস্টেম সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে ওঁকে বিভিন্নরকম প্রশ্ন করা হয়, আমিই বসে প্রশ্নগুলো তৈরী করে ছেলেমেয়েদের দিয়ে করাই৷


জর্জের জন্য আমার মায়া হয়৷ বড্ড মায়া হয়৷ ঘুমের মধ্যে 'মুভ অন ' আর 'মুভ আউট' শব্দদুটো বেঁকেচুরে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে বেড়ায় চোখের সামনে৷



--
২০০১ সালের গল্পটাও প্রায় এরকমই ছিল৷ তখন আমি কলকাতায় একটা ছোটখাট কোম্পানিতে ছিলাম৷ তাদের সব ক্লায়েন্টই ছিল আমেরিকার৷ ডটকম বাবল চুপসানো ও ৯/১১র পরে যখন আমেরিকায় আইটিওয়ালাদের হুড়মুড়িয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, সেইসময়ও আমরা তেমন কোন চাপ নিই নি৷ সেই আমার দেখা প্রথম মন্দা৷ এর আগে দাদুর মুখে শুনেছি সেই গ্রেট ডিপ্রেশানের গল্প৷ স্বাচ্ছল্য জিনিষটা তখনও পর্যন্ত কখনও তেমন করে দেখি নি বলে মন্দা নিয়ে আলাদা কোন দুর্ভাবনা ছিল না৷ শুনছিলাম চারিদিকে চাকরী যাওয়ার খবর৷ আমাদের কোম্পানিতেও শুনলাম জনা কুড়ি লোককে হঠাত্ই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এদের নাকি 'পারফরমেন্স ইস্যু' ছিল৷ তবে আমাদের আর ভয় কি, প্রোজেক্টেই তো আছি৷ আমি তখন একটা পাইলট প্রোজেক্টে৷ ডিসেম্বারের শেষ সপ্তাহে প্রোজেক্ট ম্যানেজার ডেকে বললেন, বাজেটের কিসব সমস্যার জন্য আমাকে ও আরো দুজনকে দুই সপ্তাহ বেঞ্চে বসতে হবে৷ দুই সপ্তাহ পরে বাজেট স্যাংশান হয়ে গেলেই আবার প্রোজেক্টে ফেরত৷ খুব জোর দিয়েই বললেন এটা মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যপার৷ আমরা বিশ্বাসও করলাম৷


বছর শেষ হবার ঠিক দুদিন আগে আমাদের সবাইকে বলা হল পরের দিনই লাইব্রেরির বই ফেরত দিতে৷ মেইল এলো তো বটেই, অন্তত বার সাতেক ফোন করে তাগাদাও দিল লাইব্রেরিয়ান মেয়েটি৷ নাকি পরেরদিন অডিট৷ পরের দিন বই নিয়ে নেওয়া হল৷ সেদিনই কানাঘুষোয় শোনা যেতে লাগল, বড়দরের ছাঁটাই আসছে ৷ তার পরের দিন সকালে অফিস যেতেই সিইও মশাইয়ের মেল পাওয়া গেল যে তিনি অত্যন্ত দু:খিত চিত্তে, ভগ্নহদৃয়ে কিছু কর্মীকে বিদায় জানাতে বাধ্য হচ্ছেন৷ তিনি দেখবেন এদের বিদায় যাতে অত্যন্ত 'স্মুদ' হয়৷ 'স্মুদ' শব্দটা দেখে যত অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশী অবাক হলাম যখন এর আধঘন্টার মধ্যেই নেটওয়ার্ক কানেকশান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আমাদের কয়েকজনের৷ ও হ্যাঁ তখনও আমরা সেই পাইলট প্রোজেক্টের সিস্টেমই ব্যবহার করছিলাম, ওখানেই বসছিলাম৷ কারণ আমরা তো 'দুই সপ্তাহ পরে আবার প্রোজেক্টেই ফেরত' যাব কিনা, তাই৷ তা দেখলাম শুধু আমাদের তিনজনেরই ল্যান বিচ্ছিন্ন, আশেপাশের সব প্রোজেক্ট থেকেই দেখলাম লোকজনেদের কোথায়ও একটা ডেকে পাঠানো হচ্ছে, তারা যাচ্ছে, আর ফেরত আসছে না৷


এরপরে তো শুধু সময়ের অপেক্ষা৷


মনে আছে আমি আর সুভেদি গোট্টিপতি, প্রোজেক্ট লিড আর প্রোজেক্ট ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে গেছিলাম৷ মনে আছে, দুজনের একজনও চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন নি৷ মনে আছে সারারাস্তায় আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল, আর খুব জলতেষ্টা পাচ্ছিল৷ বাড়ী এসেই শুয়ে পড়েছিলাম৷ বাড়ীতে বোধহয় বেশ স্বাভাবিকভাবেই খবরটা বলে, সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷


কি গভীর সেই ঘুম৷


১০
---
রাকেশদের ব্যাঙ্ক, এই মাসের প্রথম সপ্তাহে পরপর তিনদিন কাগজে বিআপন দিয়ে দখলকরা বাড়ীর নিলাম ডেকেছে৷ দেড়পাতাজোড়া বাড়ীর তালিকা৷ রাকেশদের এজেন্সিটা বন্ধ হয়ে গেছে৷ ওদের এজেন্সির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া ৩০% লোকই নাকি লোন-ডিফল্টার হয়েছে৷ ঐ ব্যাঙ্ক তাই ওদের এজেন্সির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে৷ রাকেশের হাতে এখন অনেক সময়৷ তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নামগুলো পড়ে৷ ওদের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া সেই ৩০ শতাংশের নাম খুঁজে বেড়ায়৷


ক'দিন আগে দেশমুখ স্যারের সাথে দেখা হল৷ ট্রেনারের চাকরী ছেড়ে অনেক আশায় ড্রাইভারের চাকরী নিয়েছিলেন তিনি৷ জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী ভালই করছিলেন৷ যদিও খাটনী বড্ড বেশী ছিল --- বার দুয়েক ওঁকে টানা ২৫-৩০ ঘন্টা কাজ করতে হয়েছে৷ এক জায়গা থেকে আসলেই আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দিত গাড়ী নিয়ে৷ কোন কোন আরোহী ওঁর সাথে চোর ছ্যাঁচ্চোড়ের মত ব্যবহার করে ---- অবাক হয়ে যান অকারণ খারাপ ব্যবহার দেখে --- রেগেও যান ----- তারা উল্টে কোম্পানিতে কমপ্লেইন করে যায় --- মালিক ডেকে সতর্ক করেন ---- দেশমুখ স্যার ভেবে পান না এত মিথ্যে লোকে বলে কি করে! মার্চ থেকে কাজ খুব কমে গেছে৷ বেশ কটা কলসেন্টার হুটহাট করে হয় বন্ধ হয়ে গেছে নয়ত কর্মীসংখ্যা অনেক কমিয়ে দিয়েছে৷ ফলে কাজ অনেক কম৷ তার উপর ওঁর বদমেজাজী বলে বদনাম রটে যাওয়ায় ওঁকে আজকাল আর কাজ দিতে চায় না৷ সেই ট্রেনারের চাকরীতে ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷ তারা ফেরত নেবে, তবে মাইনে ৩০০০ টাকা কমিয়ে দেবে৷ উনি বুঝে উঠতে পারেন না কি করবেন৷


অনুরাগের চাকরী গেছে প্রায় তিনমাস হয়ে গেল৷ এখনও কিছুই পায় নি৷ রুচাদের প্রোজেক্টেরও খুব নড়বড়ে অবস্থা৷ ক্লায়েন্ট জানিয়েছে বিলেবলিটি কমাবে, আর্ধেক করবে৷ রুচা জানে এখন আর কেউ বেঞ্চে নেই, বেঞ্চে থাকে না কেউ৷ প্রোজেক্ট না থাকলে শুধু কোম্পানির এক্সচেঞ্জ সার্ভারে তাদের মেল আইডি থাকে মাস খানেক কি দুয়েক --- তারপর তাও থাকে না৷ এই বাজারে মাত্র দুই বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ও কি আদৌ কোন চাকরী পাবে? ওর ভাইয়ের অবস্থা আরও একটু খারাপ হয়েছে৷ এখন আর বসতেও পারেনা৷ একটা কাঠের গুঁড়ির মত বিছানায় পড়ে থাকে৷ কি যে করে রুচা! কোনোদিকে দিশা পায় না৷


এই মাসটায় জর্জ ভারী খুশী৷ আমাকে একদিন মেসেঞ্জারে বলেন ওঁর ম্যানেজার নাকি ওঁকে আশ্বাস দিয়েছেন আগামী ২ বছরের জন্য উনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন৷ ওঁর মত পুরানো ও দক্ষ কর্মীকে তাঁরা হারাতে নারাজ৷ তাছাড়াও আমাদেরও তো ওঁদের সিস্টেমের অন্ধিসন্ধি শিখে উঠতে অন্তত আরো বছর দেড়েক লাগবেই৷ টিমের ছেলেমেয়েরা আমাকে জানায় স্ট্যাটাস কলগুলোতেও জর্জ নাকি আজকাল খুব ভাল মুডে থাকে আর অনেক সাহায্য করে৷ আমার বানানো প্রোপোজালের পিপিটিটার কথা মনে পড়ে আমার৷ আমাদের বি ইউ হেডের আমাকে দেওয়া সময়সীমার কথা মনে পড়ে আমার৷ আইডেন্টিফায়েড রিস্কগুলোর কথা মনে পড়ে আমার৷ রিস্কতালিকায় ওঁর, বা বলা ভাল ওঁর অনুপস্থিতির একটা ভূমিকা আছে৷ ঘুমের মধ্যে আমি খাপ পেতে বসে থাকা চিতার স্বপ্ন দেখি৷


শালিনী এখনও রোজ গেটে দাঁড়ায়৷ ওদের এই শপিং মলটায় এখনও কয়েকটা দোকান খোলা আছে, তাই দাঁড়াতে হয়৷ এখন অনেকটা সময় চেয়ারে বসেটসেও থাকতে পারে শালিনী৷ বিশেষ করে শনি রবি বাদ দিয়ে সপ্তাহের বাকী পাঁচদিনে আর তেমন লোকটোক আসে না৷ ওদের শপিং মলে ঢুকেই যে মস্ত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটা ছিল, সেটা তো বন্ধই হয়ে গেল৷ প্রথমে প্রায় মাস তিনেক প্রচন্ড সেল দিল৷ প্রথমদিকে লোকে কিনতও হুড়মুড়িয়ে ৷ আস্তে আস্তে লোকের ভিড় কমে গেল দোকানটায়৷ শালিনী দেখেছে পাওয়ার কাট হলে দোকানটা এসি চালাত না৷ এই অঞ্চলে দিনে ঘন্টা চারেক পাওয়ার কাট প্রায়দিনই হয়৷ শেষের দিকে পাওয়ার কাটের সময় দোকানের আলোগুলোও সবকটা জ্বলত না৷ ফলে লোকজন আরোই ঢুকত না৷ হঠাত্ই একদিন শালিনী কাজে এসে দেখে দোকানটার সব দরজা খোলা আর ভেতরে কিচ্ছু নেই৷ একেবারে কিচ্ছু না৷ কিরকম একটা মস্ত গহ্বরের মত লাগছে দোকানটাকে৷ শালিনী শোনে ফ্যাশান স্ট্রীটে ১৫০টা দোকানের মধ্যে ৩৭টা দোকান বন্ধ হয়ে গেছে৷ অন্য কেউ এসে সেই জায়গাগুলো পূরণও করে নি৷


গত শনিবার যখন ঘড়ির ব্যাটারী বদলাতে ঢুকছি, ব্যাগটা তেমন না দেখেই শালিনী জানাল ওদের সুপারভাইজার, ওকে আজ ডেকে পাঠিয়েছে, বাড়ী যাওয়ার আগে যেন অবশ্যই দেখা করে যায়৷ ওর ডিউটি শেষ হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই৷ আমাকে জিআসা করে আমাদের অফিসে মহিলাদের ব্যাগ চেক করার জন্য লোক নেবে কিনা৷ সাথেসাথে নিজেই বলে, অফিস তো নেবে না, যে এজেন্সি সিকিউরিটি গার্ডের যোগান দেয় আমাদের অফিসে, তাদের নাম কি? আমি জানি না৷ জেনে নিয়ে জানাবো বলি৷ ফেরার সময় বেরিয়ে বাইরে যখন অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি --- দেখলাম শালিনী ওদের সুপারভাইজারের ঘর থেকে বেরিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যাচ্ছে৷ খেয়াল করলাম শালিনীর ফীগার তো বেশ ভাল৷ কিন্তু কি যেন একটা অস্বস্তি --- ও হ্যাঁ ওর সেই দুই সাইজ বড় শার্ট আর ট্রাউজারের বদলে আজ পরে আছে একটা জিনস আর টিশার্ট৷ ও তো বাড়ী যাওয়ার সময় কখনও পোষাক বদলায় না! ও বলেওছিল ইউনিফর্ম পরে থাকলে আসলে ও চাকরীটার জন্য মনে মনে গর্ব অনুভব করে৷ আমি বুঝে গেলাম আমাদের অফিস থেকে এজেন্সির নাম ঠিকানা নিলেও সেটা আর শালিনীকে দিতে পারব না৷


লালমাটির সেই রাস্তাটা স্বপ্নের মধ্যে আজকাল কিরকম ধুলো ধুলো হয়ে থাকে৷ এত ধুলো কেন চারিদিকে? এত ধুলো আসে কোত্থেকে?

8 comments:

  1. টুপি খুললাম। অসাধারণ, অপূর্ব।

    আর কী বলব, জানি না। চোখদুটো ঝাপসা লাগছে।

    ReplyDelete
  2. ভয় করছে। এমন ভয়ের গল্প লেখো কেন!

    ReplyDelete
  3. baah, daaruN laagalo, karhakarhe !!

    ReplyDelete
  4. asambhab bhaalo laaglo bolleo kichui bola hobe na..
    nityanoimittik Tanaporhen..pratiti manush chenaa, pratiTi bhoy chenaa tabu parhte parte kaa`npuni Ter paai..

    Sangita

    ReplyDelete
  5. lekhar kono tulonai nei---ajker diner bhooter golpo--ei bhoot je karur samne hothat chole ase--bhoy bhoy bhalolaga niye chollam------Nina

    ReplyDelete
  6. damayantee!
    aajake baa`nchaar cheshhTaar Je hi`msra kintu satyi chhobi tumi e`nkechh,--- ki aar balabo, Tupi khullaam!
    aare Video Games er galpoTaa to aamaar barh meye o taar boyfriend er gappo! naile oraa etodine biye kare phelaTo.
    chhoTameye Guarantor hoye didike oi 3D games er PG Diploma karate EnglanD paaThaachchhe. kintu chheleTaa? or daadaa Satyam e engineer. ekhaon aaddek maaine. or baarhite loan deyaanor mat keu nei. taai select hayeo Jete paarachhe naa. website e or kaaj dekhe anek company pachhand kare. kintu WORKPERMIT naa thakale kaaj debe naa. or nei.
    pphale chhleTaa kirakam insecure feel karachhe.

    ReplyDelete
  7. টুকরো টুকরো ছবি এঁকে কথার কোলাজ -- কঠোর বাস্তবের মুখে অনেক প্রশ্ন নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়!

    ReplyDelete