খোঁজাখুঁজি

Sunday, February 1, 2009

ছাঁটা ফুলের আসন

দমুকে বললাম দেখ নিজের জীবন থেকে একটা কিছু লিখতে হবে, যা কোনোদিন কাউকে বলা হয় নি । দমু বলল লিখে ফেলো, সমস্যা কি? আমি বললাম না মানে --- না বলা কথা । দমু বলল তাতেই বা সমস্যা কি? খুকীর গল্প লিখে দাও না । ও গল্প তো কেউ জানে না । আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোন খুকী? দমু বলল : খুকীটা আমি-খুকী হতে পারে, তুমি-খুকী হতে পারে , অথবা সেই-খুকীও হতে পারে । আসলে আমাদের এখানে তো আমি-খুকী, তুমি-খুকী বা সেই-খুকীর গল্পগুলো উল্টেপাল্টে এরটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও খুব একটা ভুল হয় না । কোথায়ও না কোথায়ও গিয়ে সব খুকীদের গল্পগুলৈ একইরকম হয়ে যায়।

ঠিকই তো .... মনে পড়ল, খুকী যখন ছোট্ট ছিল, তখন একটু ট্যালা ছিল । মানে একটু হাবলিমত আর কি ............. খুকীর দিদা ভারী সুন্দর আসন সেলাই করতেন । কিছু ছিল এমনি দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য, চটের ওপরে ক্রচেট সুতোয় ফুল লতাপাতা আঁকা । আর কিছু ছিল তোলা-আসন । এগুলো ছিল ছাঁটা ফুলের আসন । ঐ চটের ওপরেই বোনা হত উল দিয়ে । তারপর আবার সেই নকশার ওপর কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে দেওয়া হত । ফলে আসনের ওপরটা পুরো একটা গালিচার মত চেহারা নিত । তাতে কিন্তু সেলাই আলগা হয়ে খুলে যেত না । ঐ ক্রসস্টীচে বুনে তারপর ওপরটা ছেঁটে দিয়ে ফাইনাল নকশা ফোটানো হত । সবটা শেষ হলে পেছনটা লাল টুকটুকে শালু দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত । খুকীর ভারী পছন্দ ছিল এই আসনগুলো । ওকে কেউ ওতে বসতে দিত না বলেই ওর আরো বেশী বেশী পছন্দ ছিল । ভাইফোঁটার দিনে মামারা সব, দাদাভাই আর খোকা বসত লাইন দিয়ে , প্রত্যেকে একেকটা আসনে । মা, মাসিমনি, ছোটদি আর খুকী মাটিতে হাঁটুমুড়ে বসে ফোঁটা দিত ।

আজ হল গিয়ে জ্যৈষ্ঠমাসের ষষ্ঠীপুজো । কাগজে লেখে জামাইষষ্ঠী । খুকীদের বাড়ী বলে অরণ্যষষ্ঠী । আজকে মা, মামীরা, মাসিরা, দিদিরা, খুকীরাও আসনে বসে ষষ্ঠী নেবে । মা, মাসিমনি, বড়মামা, বড়মামী, মেজমামা, মেজমামীকে ষষ্ঠী দেবে দিদা । ছোটদি, দাদাভাই, খোকা, খুকীকে ষষ্ঠী দেবে মা, মাসিমনি, মামীরা । খুকী মনে মনে ভারী খুশী হয় । আজ তো আসনে বসার দিন । আজকে ও-ও ঐ গালিচার মত নরম সুন্দর ঝলমলে রঙের আসনগুলোতে বসবে । বেগুণী, গোলাপী, নীল দিয়ে নকশা করা যেটা, ঐটা নেবে খুকী বসতে । খুকী ওটার দিকে এগোতেই দিদার ধমক - "আরে ধরিস না , ধরিস না -- ঐটা ছুঁইস না, ঐটায় বাচ্চু বইব' । খুকী একটু মন খারাপ করে । "ছোটমামা বসবে ওটায়, কেন বাবা আমি একদিন বসলে কি এমন অসুবিধে হত ছোটমামার! এইটাই তো সবচেয়ে সুন্দর' । কিন্তু সুন্দর কিম্বা অসুন্দর কোন ছাঁটা ফুলের আসনেই ওকে বসতে দেওয়া হয় না । ওদের জন্য আছে তো ক্রসস্টীচে নকশাকরা চটের আসন । মা, মামীরা, মাসিমনি মাটিতেই বসে, খুকী আর দিদিরা কেউ কেউ ঐ চটের আসনে ।

খুকী ভাবে গালচের মত আসন মাত্র অল্প কয়েকটা তো, তাই ওদের বসতে দেওয়া হয় না । দিদা তো আরো বানাচ্ছে । সেগুলো শেষ হলেই এক এক করে ওরা বসতে পাবে । দিদা বানিয়ে চলে আর বিড়বিড় করে "অহন আর ভাল দেহি না চক্ষে -- কতটি বাকী আসে অহনও ---- বাচ্চুর বিয়া আইতাসে -- অর লাইগ্যা একটা বানানি লাগব --- মুন্নিরও বিয়ার বয়স হইসে --- অর জামাইয়ের লাইগ্যাও একখান লাগব -- রাজার লাইগ্যা একটা বানানি লাগে ---- খোকাও বড় হইতাসে ------ ' দিদার বকবকানি চলতে থাকে । খুকী শুনতে থাকে ---- শুনতেই থাকে । না : ওর নাম উচ্চারিত হয় না --- এক আধবার অবশ্য ওর "বর' নামক এক অনির্দিষ্ট কারো কথা শোনা যায় ---- আবার "সে অনেক দেরী' বলে চাপা পড়ে যায় ।

খুকী দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে --- শুনতে থাকে --- বুঝতে থাকে---- খুকী নেই ---- কোত্থাও নেই ----- ঐ সুন্দর রঙচঙে গালিচার মত দেখতে আসনগুলোর জীবনচক্রে খুকী নেই । খুকীর ভেতরটা হঠাত খালি খালি লাগতে থাকে । ঠিক মন খারাপ নয় কিন্তু । দু : খ , রাগ ষষ্ঠীর দিন যেমন হয়েছিল, সেসব কিচ্ছু নয় । শুদ্ধু ফাঁকা লাগে ।

খুকী আর খোকা খেতে বসেছে । দিদার সঙ্গে বড়মামী আসে একটা ছোট্ট খুরিতে দই আর চামচ নিয়ে । দাঁড়িয়ে থাকে । মা খোকাকে খাইয়ে দিচ্ছে । খোকার ভারী বায়না, মাছ খেতে চায় না কিছুতে । মা ভুলিয়েভালিয়ে খাওয়াচ্ছে । খুকী এমনিতেই চটপট খায় । শেষ করে থালাটা হাত দিয়ে চেটে পরিস্কার করে বড়মামীর দিকে তাকায় । কিন্তু বড়মামী তো ওর দিকে তাকাচ্ছেই না । খুকী তাই বলে "হ্যাঁ এইবারে দাও' । বড়মামীমা হঠাতই কিরকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে । মা বলে "আরে ওটা তোর জন্য নয়' । খুকী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে ওঠে "আমি তো দই খুব ভালোবাসি' । বড়মামীমা অপ্রস্তুতভাবেই "আচ্ছা আচ্ছা' বলে ওর পাতে ১ চামচ দই তুলে দেয় । মা খোকার পাতের পাশে জায়গা করে বলে "তুই আর কতক্ষণ দাঁড়াবি বৌদি! এইখানে দিয়া যা গা '। বড়মামী বাকী সমস্ত দইটা খোকার পাতে দিয়ে বাড়ী চলে যায় । পাশাপাশিই বাড়ী ওদের । দিদা কটমট করে খুকীর দিকে তাকিয়ে বলে "এত লোভ কেন তোর?"


খুকী অবাক হয়ে যায় --- ভীষণ অবাক হয়, "অপমানবোধ' নামক অনুভুতিটার সাথে তখনও চেনাজানা হয় নি, তাই বুঝতে পারেনা এরকম লাগছে কেন? কিরকম যেন একটা লাগে ...... কানগাল সব গরম, হাত পা ছুঁড়তে ইচ্ছে করছে আবার হাতপা নাড়াতে ইচ্ছে করছে না । এক্ষুণি এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, অথচ উঠে গিয়ে আঁচাতেও ইচ্ছে করছে না । খুকীর ভিতরটা হঠাত্ই আবার খালি হয়ে যায় । ফাঁকা হয়ে যায় ।

খুকী বড় হতে থাকে আর খুকীর পিঠে একটা ডানা গজিয়ে যায় পাতলা ফিনফিনে জলরঙের ডানা, তাতে সোনালী রুপোলি ফুল ------ খুকী একদিন মস্তবড় হয়ে যায় ---- বড় হয়ে ডানা মেলে উড়ে যায় । "সে' চলতে থাকে ------ চলতেই থাকে ---- পথ শেষ হয় না --- ঠ্যাঙাড়ে হীরুরায়ের বটতলা পেরিয়ে, সোনাডাঙার মাঠ ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা চলে এসেছিল -- সে রাস্তার তো শেষ নেই -- শেষ থাকতে নেই তার --- আমি-খুকী, তুমি-খুকী , সেই-খুকীরা সেই পথ ধরেই চলতে থাকে, যতদিন না তাদের একজোড়া ফিনফিনে পাতলা ডানা গজায় । খুকীরা জানে, নিজেনিজেই জেনে যায়, যে জায়গা ছেড়ে আসা যায়, সেখানে আর কখনও, কক্ষণো "ফেরা' যায় না । সেখানে আবার যাওয়া যায়, কিন্তু "ফেরা' যায় না ।


ছাদে ইজিচেয়ারে কফি আর বই নিয়ে আয়েস করে বসে সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে ---- সেই-খুকী কোনোদিনই আর ছাঁটা ফুলের আসনে বসে নি, কি এক প্রবল অনীহায় এই আসনবোনার বিশেষ পদ্ধতিটা শেখার চেষ্টাও করে নি । কোন দু : খও নেই তার জন্য । খোকার জন্য বানানো আসনটা আছে মায়ের কাছে, ভাইফোঁটার দিন ভাইয়ের জন্য পেতে দেয় মা । একদিন সেটার ছবি তুলে অর্কুটে লাগালো, এক বন্ধু একেবারে মুগ্ধ ; জানতে চায় আসনবোনার পদ্ধতি । সেই-খুকী চীত্কার করতে চায় "জানিনা , জানিনা , জানিনা, জানতে চাইও না' , বলা যায় না । ভদ্রভাবে বলে "জানি না' । বন্ধু খুব দু:খ করে আগেকার এইসব শিল্পসৃষ্টি সব হারিয়ে যাচ্ছে বলে । সেই-খুকী হাসে । এখন ও জানে, টের পায়, ওকে আসনে বসতে দেয় নি যে, সে নিজেও কোনোদিন বসে নি নিজের সৃষ্ট ঐ রূপকথার টুকরোগুলোয় । অল্প অল্প হাসি পায় ---- আসনের চেয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে আরাম অনেক বেশী । করুণা হয়, মায়া হয় দিদার জন্য । তাও কোথায় যেন একটা তেতো স্বাদও লেগে থাকে --- বলা হয়নি ---- "তুমি জানতেই পারনি, টেরও পাও নি, কত্তদিন আগে ঐ ছোট্ট লোভগুলো টুপ টুপ করে মরে গেছে, সাথে নিয়ে গেছে তোমার জন্য রাখা ভালবাসাটুকুও' ।

* লেখাটি সচলায়তন ডট কম প্রকাশিত "কাঠগড়ায় গল্প' নামক e- বুক-এ ছাপা হয়েছিল। খুব সামান্য কিছু পরিবর্তন করে এখানেও তুলে রাখলাম।

No comments:

Post a Comment