খোঁজাখুঁজি

Sunday, September 17, 2006

একটা পুজো, দুইটা পুজো

কড়ে আঙুলে গুনে গেঁথে রাখি কয়টা পুজো দেখলাম। স্কুলে সব্বাই জিগ্যেস করবে তো "কটা ঠাকুর দেখলি রে"? অথচ, কোনোবারই সংখ্যা দশ ছাড়ায় না। অথচ, অন্যেরা কত কত ঠাকুর দেখে। চারদিনই দেখে। কলকাতায় থাকতাম সময়ে তো একদিন বাবা নিয়ে বেরোত। তাও প্রায় দিনেদিনেই। সন্ধ্যের পর থেকে তো বাবা যাবে 'বনফুলে'। বিজয়ার দিন বাবা নিয়ে যেত আউট্রাম ঘাটে, আর অল্প একটু অন্ধকার হতেই ফেরত। সেখানেও মাত্র ২-৩ টে ঠাকুরই দেখা হত। অত তাড়াতাড়ি শুধু বাড়ীর ঠাকুরই দুই একখান আসে তো।

পুজোর চেয়ে যেন পুজোর আগেপরেই বেশী ভাল ছিল। সেই যে কব্বে থেকে দোকানে যাওয়া বাবা মার সাথে। যেতে তো বেশ লাগত, কিন্তু তারপরেই ওরা যেই কতকত শাড়ী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, অমনি আমার কিরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকত। প্রায় প্রতিদিনই আমার ও একটা করে জামা কেনা হত আর ততক্ষণ ভালই লাগত। একবার সেই যে একটা কচি কলাপাতা রঙের জামা , কত্ত চাইলাম। বাবা তো রাজীও হল, মা কিছুতেই কিনতে দিল না। সেই একই ডিজাইন হাল্কা গোলাপী রঙের নিল। দূর মা'টা এমন ইয়ে। অ্যাল।।।।। কোন লোককে "টা" বলতে নেই ---- তা কি করব--- কচি কলাপাতা রঙের মধ্যে কেমন সাদা সাদা ফ্রিল দেওয়া ছিল। ঐ হাল্কা গোলাপীর সাথে সাদা তো প্রায় কাছাকাছি রঙ। তেমন লাগছেই না চোখে।একদিন আবার দাদু দিদা আসবে জামাকাপড় দিতে। একটা জামা দিদা, একটা বড়মামা দেবে। আর বাবা সেবারে বোম্বে থেকে যে ৩ টে জামা এনেছিল, মা তো তার থেকেও দুটো রেখে দিয়েছে। অথচ, পুজোর মধ্যে এত জামা পরাই হয় না। দশমীর পরে পরেই একদিন কোন্নগর, একদিন কল্যানী, একদিন টালিগঞ্জ তো একদিন শিবপুর। বাবা যাবে পায়জামা পাঞ্জাবী পরে। মাকে কি সুন্দর লাগে লালপাড় ওয়ালা কটকী বা অন্য কিসব যেন শাড়ি পরে, লাল টুকটুকে টিপ পরে। মা'কে তখন কি সুন্দর যে লাগত। মা আবার খোঁপার ওপর দিয়ে অল্প করে ঘোমটাও দিত। আর আমার ট্যাবলাটোবলা ভাইটা মুখের ভেতরে গোটা বুড়ো আঙুল পুরে সমানে দুষ্টুমী করে যেত। ফর্সা টুকটুকে হাতের বুড়ো আঙুল সর্বদা লাল আর লালায় ভেজা। কোন্নগরে মামাবাড়ী আর কল্যাণীতে পিসীর বাড়ী যেতে আমরা সবচেয়ে ভালবাসতাম। দুইবাড়ীতেই ভর্তি ভর্তি দেব সাহিত্য কুটীরের পূজাবার্ষিকীগুলো। সেই যে অপরাজিতা, জয়যাত্রা, শুকসারী, ইন্দ্রনীল, পূরবী, তপোবন, বোধন, নবপত্রিকা ----- । আর কোন্নগরে ছোটদি আছে, ছোটমামা আছে। কল্যাণীতে আছে দাদা, ছোড়দি। বাড়ীগুলো কত্ত বড় বড়। আশেপাশে কতরকমের গাছ, কত ফুল।


এ ছিল মাত্রই ৩ বছরের গল্প। খুব একটা রঙীন নয়, তবুও খুব একটা কমও নয়তো। তারপর থেকেই রং কমতে লাগল। পাড়ার ভাঙ্গাচোরা ক্লাবঘরে যেদিন সন্ধ্যেবেলা মাইকে তারস্বরে বেজে উঠল "কিনে দে রেশমী চুড়ি ---" বুঝলাম পরেরদিন সক্কালে মহালয়া,। দিন ২০-২৫ আগে মা গেছিল ছোটমামার সাথে আমাদের জামা কিনতে। ব্যাগের ভেতর থেকে টাকার ব্যাগটা কে যেন উঠিয়ে নিয়েছে। আমি নীল রং ভালোবাসি --- এই বারে তো বাবা 'নেই', তাই সাধ্যাতিরিক্ত দাম দিয়ে মা কিনেছিল নেভি ব্লু আর সাদা রঙের ঐ অদ্ভুত সুন্দর জামাটা। বাবা তো কিনে দিত প্রতিবার কতগুলো করে। এই কদিনে কতবার যে শোনা হয়ে গেছে আমার জামাটা অত দাম দিয়ে না কিনতে হলে ব্যাগ টা যেত না, ভাইয়ের আরেকটু ভাল জামা হত। মা কিরকম দিশেহারা মত হয়ে ছিল কদিন , সেই ব্যাগটার জন্য। জামাটা তো পরেছিলাম অষ্টমীর দিন, সেই যে ছোটমামা বেরোল আমাকে, ভাইকে আর ছোটদিকে নিয়ে ঠাকুর দেখাতে। একটা,, দুইটা, তিনটা ......... সাতটা পুজো দেখেছিলাম। জামাটা পরতে কেমন যেন একটা অপরাধবোধ হত ---- খুব কম পরা হয়েছে সে জামা। বড্ড পছন্দ হয়েছিল তো --- তাই প্রত্যেক পুজোয় আমার ঐ জামাটার জন্য মনকেমন করে। পরতে ইচ্ছে করে --- করেনা --- করে --- না-আ:।


বেশ বড় হয়ে গেছি, ক্লাস নাইনে পড়ি বোধহয়। অষ্টমীর দিন ছোটমামা বেরিয়েছে আমাদের নিয়ে, সাথে ছোটমামার পুঁচকে এক বছরের মেয়ে। আমাকে আর ছোটদিকে চারটে ঠাকুর দেখিয়ে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেল। ভাই আর পুঁচকুকে নিয়ে আরো অনেক ঠাকুর দেখাতে। ওকে দূর্গাঠাকুর চেনাতে হবে --- তাই। কি ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম, অথচ কিছু বলতে বড্ড প্রেস্টিজে লেগেছিল। আরো বড় হয়ে বুঝলাম, আসলে ছোটদি তো বটেই, আমিও তখন "বড় হয়ে" গেছি। তাই ছোটমামা সাহস পায় নি। কবে থেকে যেন প্রত্যেকবার পুজোর সময়ে মা'কে বলতাম কলকাতায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতে, কেউ নিয়ে যেত না। নাকি বড্ড ভীড়, হারিয়ে যাব, এইসব। কোন্নগরের মধ্যেও দুইটা ঠাকুর, তিনটা ঠাকুরই দেখা হয়। তার বেশী হয় না। একলা একলা বন্ধুদের সাথে যেতে দেওয়া হয় না, কেউ নিয়েও যায় না, পাড়াতেও পুজো হয় না, শুধু কালীতলা থেকে ঢাকের শব্দ শোনা যায়। পড়তে বসতে হয় না। আর অনেক গল্পের বই পড়া যায়। পুজোতে আর তেমন রং থাকে না। রোদ্দুরও কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে আসে বেলা ৩ টে বাজতে না বাজতেই। লক্ষ্মীপুজো বরঙ অনেক ভাল। বাড়ীতে হবে খিচুড়ি পায়েস। পাড়ার কত লোক সন্ধ্যেবেলা আসে ভোগ খেতে। সক্কালবেলায় ফোটা ধবধবে সাদা স্থলপদ্মগুলো ততক্ষণে গোলাপী হয়ে গেছে।


আরো বড় হই আমি। পুজো মানে এখন পুজোসংখ্যা, শুধুই পুজোসংখ্যা। কোনটায় কি ভাল লেখা বেরোল। মহালয়ারও কত্ত আগে বেরিয়ে যায় সব। কিন্তু জমিয়ে রাখি ঐ কটা দিনে পড়ব বলে। নাহলে কাটবে কি করে ছুটির দিনগুলো? পাড়ায় একটা পুজো হয়। একটা ঠাকুর দেখা হয়। ঢাকের বাদ্যি কানের এক্কেরে গোড়ায় বাজে। মাথা ধরে যায়। পঞ্চমী কিম্বা ষষ্ঠীর দিন প্রিয় বান্ধবীর বাড়ী যাওয়া ---- সেই পাড়ায় বেশ বড় পুজো। দুইটা ঠাকুর দেখা। আপিস যেতে আসতে এদিক ওদিক আরো দুই একটা পুজো দেখা হয়ে যায়। এখন পাড়ায় পাড়ায় পুজোর দিনগুলোতে কত প্রতিযোগীতা হয়। মোমবাতি নেভানো, শাঁখ বাজানো, আরো কতসব। মেথরপট্টির ছেলেরা একটু পিছনে দাঁড়িয়ে দেখে। উদারহৃদয় কোন কর্মকর্তার উদাস আহ্বানেও সামনে এগোয় না। বর্ষীয়ান এক শিক্ষক আড়ালে ধমকে দেন ঐ কর্তাকে -- "ছোটলোকগুলোকে অষ্টমীর দিন যে এক পেট খাওয়ানো হয়েছে ঐ ঢের। আর অত কাছে ডাকতে হবে না"। কে না জানে ওরাই আসলে মুখার্জী বাড়ীর গামলা বালতিগুলো নিয়ে গেছিল। প্রমাণ? প্রমাণ হলে তো মেরেই শেষ করে দিতাম। ব্যাটারা কম বদমাইশ নাকি। ইত্যাকার আলোচনা চলতে থাকে পাড়ের নকশার সাথে মেলানো নতুন গড়ানো মীনা করা কানের দুলের প্রশংসা এবং ক্রাইপার রোডের নতুন ফ্ল্যাটের দাম, মিউনিসিপ্যালিটির নতুন চেয়ারম্যানের দক্ষতা অদক্ষতার হিসাব মেলানোর সাথেসাথেই। ঐ একটা পুজো ও আর তেমন রঙীন লাগে না। রঙ জ্বলে যাওয়া ম্যাড়ম্যাড়ে পুজোর গা থেকে আংশটে গন্ধ আসে
তার থেকে টিভিতে "শারদ সম্মান" পাওয়া পুজোগুলো অনেক রঙীন। কেমন সুন্দর --- একটুও বেমানান কিছু নেই।


এখন আর একটা পুজো ও দেখা হয় না অনেকসময়ই। বাড়ীতে থাকলেও দরজা খুলে বেরিয়ে পাড়ার মোড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। আগে ইচ্ছে করত, কেউ না নিয়ে গেলে একলা একলাই গিয়ে অনেক অনেক পুজো দেখতে রাত্তিরবেলা। এখন ভীড় দেখলেই কিরকম অতিষ্ঠ লাগতে থাকে। অনবরত ঢাকের আওয়াজে মাথা ধরে যায়। কবে যে ইচ্ছেগুলো মরে গেল চুপি চুপি একা একা -- একটুও জানতে দিল না! আকাশের রঙ বদলায়, রোদ্দুরের রঙ বদলায়, কেমন হলদেমত রোদ্দুর --- মনে পড়ে নীল সাদা জামাটা ---- সাদার মধ্যে নীল তিরিতিরি। জামাটাও তো কবেই মরে গেছে চুপি চুপি একা একা।

1 comment:

  1. khub sundor lekha. PoRe ektu mon kharap holo kintu boddo bhalo laglo.

    Debsahityo Kutirer potrikagulor nam shunlam kotodin por!

    ReplyDelete