খোঁজাখুঁজি

Saturday, January 7, 2006

থোড় বড়ি খাড়া

'৯৫ সালের বইমেলায়, নির্ঝঞ্ঝাটে বই দেখার জন্য একটি অপেক্ষাকৃত ফাঁকা দোকানের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে "থীমা"তে যে বইটির প্রচ্ছদ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম, তার নাম 'থোড় বড়ি খাড়া"। লেখক কল্যাণী দত্ত। কমলা রঙের হার্ড কভারে সাদাকালো ছবি আঁকা, ১৩১ পৃষ্ঠার কৃশকায় বইটির প্রতিটি পাতায় যত্নের ছাপ। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ পূর্ণেন্দু পত্রী। এমন নয়নশোভন বই বাঙ্লায় খুব যে বেশী দেখা যায় তা নয়।


এটি কোন মহতী উপন্যাস, কালজয়ী গল্প সঙ্কলন, গুরুগম্ভীর প্রবন্ধরাজী নয়, নয় রম্যরচনা বা আত্মক্থাও। তবে এটি কি? এটি কিছু ঘরোয়া অন্তরঙ্গ কথা, গল্পের আঁকিবুকি৷ বাড়ীর মাসিপিসীদের কথা। বিখ্যাত ব্যক্তিদের ঘরোয়া জীবনে আমজনতার প্রচুর কৌতুহল, কিন্তু এ তো তা নয়। তবে কেন লেখা? লেখকের কথায় 'কিন্তু আমি যে মাসি, পিসী, খুড়ী, জেঠির মুখের কথা এখানে জড়ো করেছি, গেরস্ত ঘরের বউ ছাড়া তাঁদের আর কোনো পরিচয় নেই। তাছাড়া মাসিপিসী তো সকলের ঘরেই আছেন, লোকে একই ধরনের সেইসব কথা শুনতে চাইবে কেন? একথার একটাই উত্তর সভয়ে নিবেদন করচি। সেটা এই যে আমি যেসব গিন্নীবান্নিদের সঙ্গে মিশেছিলুম তাঁরা কেউ কেউ বয়সে আমার চেয়ে চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, এমনকি সত্তর বছরেরও বড় ছিলেন। তাই তাঁদের থোড়বড়িতে একটু কি যেন ছিল অন্য সোয়াদ। সেগুলোই জোড়াতালি দিয়ে একত্তর করে দিলুম।" এই "সোয়াদ" আর "একত্তর" শব্দদুটি এক ঝটকায় যেন বইয়ের বিষয়বস্তু চোখের সামনে এনে দেয়।


সেই মাসিপিসীরা যাঁদের বৃহদংশই ছিলেন বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের বালবিধবা। যাঁরা জানতেন ও মানতেন হাজারো রকমের এঁটো ও সগড়ি। এঁটোর মধ্যে প্রধান মুখের এঁটো, পাতের এঁটো ও ভেন্ন জাতের এঁটো, সগড়ির মধ্যে শুকো, ভিজে ও হাজা সগড়ি। সব মানতে হত, নইলেই মহাভারত অশুদ্ধ। এহজম্মো তো ঘুচেই গেচে, পরজম্মো যাতে ঠিকঠাক থাকে তারই চেষ্টা। তিনি লিখছেন "আমার দিদিমাকে বছরে মাত্র একবার বিজয়া দশমীর রাতে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেচি, তিনি তক্ষুনি পা ধুয়ে ফেলেচেন।" লিখছেন কিন্তু কোন ক্ষোভ বা দু:খ নিয়ে নয়, বড় সহজভাবে, যেন সামনে বসে গল্প বলে চলেছেন এমনই লাগে। বইটিতে ১২ টি অধ্যায়।
কেন লেখা
ঘরদোর
ভেতর বাড়ি
ঠাকুর ঘর
রান্না ভাঁড়ার
মাছ
আম
তজ্জ্বকথা
গয়নাগাঁটি
মেয়েমহল
দোয়াতকলম
খাঁচার পাখি


এই তালিকা দেখেই বহুজনে নাক কুঁচকিয়ে নামিয়ে রাখবেন বইটি জানা কথাই, তা তাঁদের জন্য নয়ও এ বই। এ বই তাঁদের জন্য যাঁরা যেতে আসতে দালানের কোণে পড়ে থাকা "কাটগেলাসের টুকরো"টুকুও মন দিয়ে লক্ষ্য করেন।


'ঘরদোর' অংশে পাচ্ছি সেকেলে বাড়িগুলি ঘরের বিন্যাসের বিবরণ। আর পাচ্ছি ঘরের আসবাবপত্র আর টুকিটাকি জিনিষপত্রের বিবরন। দেখতে পাচ্ছি এইসব গৃহিণীদের শোবার ঘরে থাকত প্রচুর খেলনাপাতি, পুতুল ইত্যাদি। আট, নয়, দশ বছুরে যে বালিকাটি বিয়ে হয়ে সম্পূর্ণ অচেনা এক বাড়ীতে যেত, তার কান্না থামানোর জন্যই প্রয়োজন হত প্রচুর খেলনার। সেই থেকেই গায়ে হলুদ আর চড়কে খেলনা দেবার রেওয়াজ দাঁড়িয়ে যায়। থাকত কেষ্টনগরের মাটির পুতুল, বিলিতি পোর্সিলেনের সাহেব মেম পরী। "হাতীর দাঁতের ঠাকুরদেবতা, জন্তুজানোয়ার, ছোট্ট গড়গড়া, মেহগিনির মধ্যে হাতীর দাঁতের পাত ঢুকিয়ে মুসলমানি ফুলপাতার অপুর্ব নকশাতোলা থালা (ওয়াল প্লেট), সবসুদ্ধু সাজানো আলমারীতে চিরকাল তালা ঝুলত। ছোট মেয়েরা ইটপাথর, কাঁই বিচি, রীঠের বীচি, থ্যাবড়া থোবড়া কাঁচের পুতুল, লোহার মধুপুরি হাতাবেড়ী নিয়ে ঘর পাতত। তাদের সাধের সংসার একটি মেলিন্স্ ফুডের বাক্সেই ভরাভর্তি থাকত।" লেখকের বর্ণনায় এইভাবে যে খড় আর মাটির চেহারাগুলি দেখা যায়, তাই চুম্বকের মত টেনে নেয় পরবর্তী অধ্যায়ে।


'ভেতর বাড়ি'তে তত্কালীন একান্নবর্তী পরিবারের কিছু খন্ডচিত্র পাই। সেই তখন,যখন মধ্যবিত্ত অধ্যাপকের বাড়িতেও সবসময় বিশ-তিরিশজন লোক থাকতই। পালেপার্বণে যা পঞ্চাশ-ষাটজন হেসেখেলেই হয়ে যেত। সেই মধ্যবিত্ত পরিবার, যা তার ফুল ও কাঁটা দুই নিয়েই বিরাজ করেছে। কলকাতার যৌথ পরিবার অনেকসময়ই একটি বাড়িতে আবদ্ধ থাকত না, প্রায় গোটা পাড়া জুড়ে শেকড় গেড়ে বসত। সবাই সবাইকার হাঁড়ির খবর রাখত, সুখে দু:খে ছুটে আসত, নিন্দেমন্দ, ঝগড়াঝাঁটি, কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি সবেরই ভাগাভাগি ছিল। সুগন্ধ বা শৌখিনতা ছিল না, তবে একটা অকপট, অমার্জিত রুপ ছিল।


বেলা আটটা না বাজতে আপিসের বাবুদের ভাতের তাড়া শুরু হত। রাঁধুনি-বামুন থাকলেও বউ-মেয়েরা তটস্থ থাকতেন এই সময়টা। "বাবুদের সগড়ি তক্ষুনি পেড়ে না নিলে এঁটো চন্ডী আপিসে গিয়ে কাজ ভন্ডুল করে দিতেন" এই কথা পড়ে আজকের আমি হেসে উঠি, কিন্তু এ বই না পড়লে জানতেও পারতাম না এহেন একটি বিপদের কথা। বাবুদের পরে খেতে বসত ইস্কুল কলেজের পড়ুয়ারা, তারপরে কুচোকাচা, রুগিদের, বুড়োদের মর্জিমাফিক খাইয়ে তারপর বাড়ীর মেয়েবউরা খেতেন, এরপরে ঝি-চাকরদের ভাত বেড়ে দিয়ে তবে বাড়ীর গিন্নী যখন খেতে বসতেন, তখন প্রায়ই মাছ তরকারী কম পড়ে যেত। পড়ে থাকত ছ্যাঁচড়ার কাঁটা, চচ্চড়ির ডাঁটা, পাতলা ডাল ও পাথরের খোরায় পুঁটি ও মৌরলা মাছের তলানি অম্বল। তাই দিয়েই তৃপ্তি সহকারে খেতেন তাঁরা, কেউ কেউ আনিয়ে নিতেন উড়িয়া দোকানের ফুলুরি।


এই বইটির আরেকটি বড় আকর্ষণ হল প্রবাদ-প্রবচন বা প্রচলিত ছড়ার উল্লেখ। এরকম ২-১ টা উদাহরণ দেবার লোভ সামলাতে পারছি না।


"তুমি কেমন বড়মানুষের ঝি
তা কাঁচকলাটা কুটতে দেখে খোসায় বুঝেছি।"


"লাউ করে হাউ হাউ কে রেঁধেছে?
আমি তো রাঁধিনি বাবা, বউ রেঁধেছে।
আহা, তাই তো অভাগা লাউ মধু হয়েছে।"


"ঠাকুরঘর"এ যেমন বাড়ির স্থায়ী গৃহদেবদেবী বিবরণ আছে, তেমনই আছে বারো মাসে তেরো পার্বণের কিছু কিছু বিবরণ। লক্ষ্মী ও সত্যনারায়ণ পুজো প্রায় সব বাড়ীতেই হত। প্রত্যেক বাড়ীতেই কোনো শুভ অনুষ্ঠানের পর সত্যনারায়ণ পুজো দেবার বিধি ছিল। পুরোহিতের দক্ষিণা ছিল ষোলোআনা, এছাড়া লালপেড়ে ধুতি ও গামছা ।


"রান্না-ভাঁড়ার" এর শুরুতেই একটি মজার ঘটনার উল্লেখ পাই। বেলতলার লাহিড়ী গিন্নীদের রাঁধিয়ে বলে সুনাম ছিল। তা লেখক তাঁদের কাছে একবার মাছের কি একটি রান্না শিখতে চাওয়ায় বড়বৌরানী সখেদে বলেছিলেন , "শেখাতে তো অনিচ্ছে নেই বাছা, সেই উনুন ধরানো থেকে কড়া নামানো সবই দেখাতে পারি, কিন্তু দু-চারটে কথা তো না বললেও নয়। যেমন উনুনটি ধরানোর জন্য কাঠকয়লার সঙ্গে প্রচুর ভালো গুড়ের মুড়কি দিও। তবে যে আঁচটি উঠবে সেই মুড়কির ভাপেই রান্নার 'সদ' বাড়বে।" বলা বাহুল্য লেখক যেসব রান্নাঘর দেখেছেন, সেখানে উনুন ধরানোর অনুপানের সঙ্গে মুড়কি ছিল না।


বাসনকোসনের মধ্যে কাঠের, কাঁসার, লোহার ও শুদ্ধ বাসন বলতে তামা ও পাথরের বাসনই প্রচলিত ছিল। ভাঁড়ার ঘরে জমা থাকত সোমবচ্ছরের বড়ি, আচার, কাসুন্দি, আমসি, আমচুর ও নানারকম মশলা। এছাড়াও থাকত বাঘের নখ, হরিণের শিঙ, কুমিরের দাঁত, শজারুর কাঁটা, সমুদ্দুরের ফেনা, ঘেঁচি কড়ি ইত্যাদি। এইসব উনকুটি চৌষট্টি নিজেদের আর পড়শীদের জন্য সাজিয়ে গিন্নীরা ভারী তৃপ্তি পেতেন। কেউ চাইলে তাঁরা ধন্য হয়ে যেতেন। জব স্যাটিসফ্যাকশান কে না চায়!


প্রত্যেক ভাগ ধরে ধরে বাকীটুকু আর লিখব না। আগ্রহী পাঠক খুঁজে পড়ে নেবেন।


সংক্ষেপে ২-১ টি কথা।
"থোড় বড়ি খাড়া" র পরেই বেরিয়েছিল "পিঞ্জরে বসিয়া"। তারপর "ছিটমহল" এছাড়া বোধহয় আরেকটি বই "প্যাঁচা"। এই শেষোক্তটি আমি পড়ি নি। তারও পরে লেখকের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় "খাড়া বড়ি থোড়'। তবে প্রথম ৩ টির পরে "খাড়া বড়ি থোড়" কে কিছুটা ম্যাড়ম্যাড়ে, একঘেয়ে লাগে। যাঁরা মানবীবিদ্যার পাঠে আগ্রহী, "পিঞ্জরে বসিয়া" তাঁদের অবশ্যপাঠ্য৷

No comments:

Post a Comment