‘মেয়ে’ বা ‘মেয়েলী’ বলতে সাধারণভাবে সমাজ মনে করে ঊনমানব, অপর বা আদার, উইকার সেক্স বা দূর্বলতর লিঙ্গ, সেকেন্ড সেক্স বা দ্বিতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি। সবসময় যে অতি উচ্চকিতভাবে এটা বলা হয় তা নয়, কিন্তু বহুকাল ধরে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয়ে এসেছে তার সারাংশ মোটামুটি ওইরকমই। বৈষ্ণবকাব্যে কৃষ্ণ বিরহিতাকে খন্ডিতা বলা হয়। কিন্তু বাকী সব মেয়েরা যারা জন্ম থেকেই জীবনের নানা রঙ রস রূপ উপভোগে বিচ্ছিন্ন থেকেছে তাদেরাও কি খন্ডিতা বলা উচিৎ নয়? যশোধরা রায়চৌধুরী মনে করেন অবশ্যই বলা উচিৎ। এই যে দৃষ্টিভঙ্গী যে মেয়ে সাজবে, মিষ্টি করে হাসবে, বোকা কথা বলবে, অর্থনীতি রাজনীতি বুঝবে না এ তো একটি পূর্ণ সত্ত্বার উপরে এক খন্ডিত সত্ত্বার আরোপ। এই আরোপিত সত্ত্বাকেই যশোধরা দেখেছেন নানাদিক থেকে।
নব্বই দশক থেকে এখন অবধি নানা পত্র পত্রিকা,
ই-পত্রিকায় প্রকাশিত যশোধরার প্রবন্ধ,
নিবন্ধ, উত্তর সম্পাদকীয় লেখা ও আত্মকথনধর্মী লেখায় গড়ে উঠেছে ‘খন্ডিতার
আত্মদর্শন’ বইটি। নারীর চিত্রায়ণ, নারীশরীর আর হিংসা, নারীর
বাস্তবতা, নারী আর সম্পর্ক এই চার পর্যায়ে ভাগ করে মোট ২৯টি রচনা স্থান পেয়েছে ২৪৬ পৃষ্ঠার বইতে। নারীর
দৃষ্টিকোণের প্রতি একটা সাধারণ অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় ‘ও
তো একপেশে দেখা’। লেখকের
কথায় সেই একপেশে নারীবাদকেই নিজের জীবন যাপন ও চর্চার কেন্দ্রে রেখে, ভালবেসে,
সওয়াল করে কেটে গেছে এতকাল। সেসব সওয়াল জবাব, নারীর দৃষ্টিভঙ্গী নারী ছাড়া কেইবা
তুলে ধরবে বারেবারে। হিজ স্টোরি যদি হিস্টরি হয় তবে তো তার মধ্যে হার স্টোরিগুলো
লুকিয়েই রইল। একপেশে দৃষ্টি ছাড়া সেগুলো আলাদা করে উপস্থাপন করা যাবেই বা কী করে?
আমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে আমরা যে সময়টাতে
বাঁচছি সেই সময় মানবীবিদ্য্যচর্চার ধারাবাহিকতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের আত্মোপলব্ধিকে
ভেঙে গড়তে সাহায্য করেছে বহুলভাবে। কিন্তু সে তো আমরা মেয়েরা, সমাজ আমাদের কীভাবে
দেখছে? হয় দেবী অথবা দানবী অথবা একের মধ্যে দুই। স্বাভাবিক দোষে গুণে ক্ষমতায়
অক্ষমতায় মেশানো মানবী নয়। সেই বামাবোধিনী পত্রিকার আমল থেকেই বা তারও আগে থেকেই
আত্মনির্ভরশীল, স্পষ্টবক্তা মেয়েদের ‘জাঁহাবাজ’
বলে চিহ্নিত করা হয়। ১৮৬৩ সালে বামাবোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে মেয়েদের
মধ্যে শিক্ষার আলো ও সচেতনতা প্রসারের
উদ্দেশ্যে। সেই শিক্ষা শুধুই অ আ ক খ নয়
বরং মেয়েদের আসলে কেমন হওয়া উচিৎ, কতটা নরম সরম সেসবও থাকত বৈকী। আজও সানন্দা বা
সুখী গৃহকোণে এরকম উপদেশাবলী পাওয়া যায়।
মেয়েদের প্রতি এই উপদেশাবলী সর্বদা পুরুষের থেকে
আসে তা মোটেই নয়, বরং অনেকসময়ই তা আসে মহিলাদের থেকেই। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোতে
বছরে তিরিশবার যে সব ট্রাডিশনাল ডে ইত্যাদি পালন হয় তাতে মহিলা এইচ আর হেড বা মহিলা বিজনেস ইউনিট হেডের থেকেই স্পষ্ট নির্দেশ
থাকে মেয়েরা সবাই যেন শাড়ি বা লেহেঙ্গা পরে আসে,
মেয়েরা যেন ভারতীয় মেয়েদের আর্কিটাইপটি যথাযথ অনুসরণ করে সাজগোজ করে আসে।
এই রূপ যারা অনুসরণ করে না তারা সেইসব জাঁহাবাজ মেয়ের দল। এরই চরম রূপ দেখিয়েছেন
লেখক যখন অবিবাহিত বাঙালি রাজনীতিবিদের
দিকে ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে ‘ঘরের
মেয়েদের সময়মত বিদায় করতে হয়।‘
‘ঘরের মেয়ে’
সে হবে নরম সরম, বিয়ে দিয়ে তাকে পরের ঘরে পাঠিয়ে দাও, রাজনীতি
থেকে বিদায় করো। বলা হয়েছে সেই বাঙলায় যেখানে ৫০ বছরেরও বেশী সময় ধরে চাকুরিরতাদের
গল্প গড়ে উঠেছে! অবাক লাগে না?
নারী শরীর ও হিংসা
পর্যায়ে আমরা পাচ্ছি ধর্ষণ ও তার বিভিন্ন প্রকার, পিরিয়ড সম্পর্কে নীরবতা, হত্যা হয়ে এই হালের মি-টু পর্যন্ত বিষয়ে
সুচিন্তিত লেখা। সাম্প্রতিককালে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তোলা মি-টু নিয়ে মূল অভিযোগ
দুটি। এক এটা একপক্ষের কথা এবং কোনও নির্দিষ্ট আইনী পদ্ধতি মেনে করা অভিযোগ নয়।
দুই অভিযোগ অধিকাংশই অত্যন্ত পুরানো তখন করে নি কেন? লেখক অসীম মমতায় দেখিয়েছেন
নিজেকে একদলা মাংসে পরিণত হতে দেখার চুড়ান্ত অবমাননাকর বিষয়টি শুধু বলে ফেলতে
পারাই মেয়েদের জন্য রিলিফ হয়ে উঠেছে। একেবারে ছোট থেকে মেয়েদের শেখানো হয় নিজের
অবমাননার বিষয় নিয়ে কথা বলতে নেই লুকিয়ে ফেলতে হয় যেন কিছুই ঘটে নি। মনের অতলে
তলিয়ে থাকে গ্লানি – ‘আমি
কেন? আমিই কেন?’ প্রশ্ন বুড়বুড়ি কাটে মনে।
টেকনোলজির সুবিধে
ব্যবহার করে কারো মুখোমুখী না হয়ে নিজের ঘরের নিভৃতিতে বসে যখনই সেই গ্লানিকে একজন
লিখে ফেললেন, দেখা গেল দলে দলে আরো অনেকে এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন আমিও,
হ্যাঁ আমিও। পথে কেউ নামেন নি, সভা সমিতি
মিছিল মিটিং কিছুই না, শুধু বলে ফেলা। বলে নির্ভার হয়ে যাওয়া। এতদিনের যে
অস্বীকার, মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, অপমানিতকে অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া, তাকে সপাটে ছুঁড়ে ফেলে নিজের অপমানের লাঞ্ছনার
গল্পটুকু বলে ফেলা হ্যাশট্যাগ মি-টুকে আঁকড়ে, এর সবচেয়ে বড় স্বস্তি লেখকের ভাষায় ‘আজ
অন্যদের কথা থেকে জানছি, ওদেরও আমার মতোই
অভিজ্ঞতা। আমিও ওদের মতোই পৃথিবীকে নোংরা ভাবতে শিখেছি, বাসে ট্রামে ট্রেনেই ভীড়ের
ভেতর অযাচিত কোন শরীরের নোংরা স্পর্শে। এদিক থেকে আমরা সবাই এক।‘
মি-টু ক্যাম্পেন চোখে
আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে শুধু গরীব নয়,
শুধু মেয়েরাই নয় , গরীব বড়লোক মধ্যবিত্ত নারী পুরুষ বালক বালিকা ঘরে ও বাইরে এক বড় সংখ্যক মানুষই আছেন বিপদের
মধ্যে। মি-টু ক্যাম্পেনের বাইরে, নেট কানেকশানের বাইরের ভারতবর্ষে মিটু কি কোন
প্রতিরোধ গড়তে পারল? নাহ, লেখক স্পষ্ট জানাচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অবিরত
ঘটে চলা যৌন লালসা ও আক্রমণ এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিন্তু আত্মহত্যার দিকে না
গিয়ে আক্রমণকারীর দিকে, সমাজের দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য, আঙুল তুলে আক্রামককে
চিহ্নিত করার জন্য আরো অনেকটা পথ যেতে হবে আমাদের। আমরা যারা গ্লোবাল থেকে লোকাল,
বিশ্বগ্রাম থেকে পাশের গ্রাম অবধি ছড়িয়ে থাকা কামুক পিচ্ছিল দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে
ছিলাম, আছি তাদের লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। কিন্তু এই প্রতীকি প্রতিবাদ যৌন হেনস্থার
অতি বিস্তৃত ক্ষেত্রটিকে টেনে এনে সবার সামনে বিছিয়ে দিয়েছে, সেটিও খানিক এগোনো
বৈকি।
নারীর বাস্তবতা পর্যায়ে
রান্নাঘরের বিবর্তন ও বাঙালি মেয়ের পোশাকের বিবর্তন দুটি আকর্ষণীয় ও কৌতুহলোদ্দীপক
রচনা। রান্নাঘরের কথা পড়তে পড়তেই মনে পড়ল মলয় রায়চৌধুরীর কোনও একটি
আত্মজৈবনিক লেখায় উত্তর কলকাতার এক রান্নাঘরের কথা পড়েছিলাম
যা ঘোর অন্ধকার, জানালাবর্জিত, অতি লো পাওয়ারের বাল্বওলা সেই রান্নাঘরে উনুনের
আগুনের দিকে তাকিয়ে দিনের ষোলো আঠেরো ঘন্টা পার করে দেওয়া মহিলার চোখের মণি প্রায়
সাদা হয়ে গেছে, স্বাভাবিক আলোয় তিনি আর কিছুই দেখতে পান না। এটি এক মোটামুটি
স্বচ্ছল বাড়িরই গল্প। সেখান থেকে বেশ
অনেকটা পথ হেঁটে আমরা আজ চিমনিশোভিত মডিউলার কিচেনের সময়ে ঢুকে পড়েছি। এই পথের
মানচিত্র যশোধরা এঁকেছেন রানী চন্দ, রবি
ঠাকুর, বিভুতিভূষণ হয়ে কবিতা সিংহ, লেখকের দিদু হয়ে ইরানের মেয়ে সামিন নোসরতের আখর
ধরে।
বিশ্বায়ন ও নারী প্রবন্ধটি আমার মতে এই বইয়ের সেরা প্রবন্ধ। বাংলাদেশের
গার্মেন্টস সেক্টর থেকে শুরু করে পৃথিবীব্যপী মেয়েদের উপর বিশ্বায়নের প্রভাব, পুঁজির প্রসারের সাথে
সাথে নারী ও শিশুদের খাদ্যসুরক্ষা ও পুষ্টির অধিকার সংকুচিত হয়ে আসা, জলের অধিকার প্রায় হারিয়ে ফেলা এই সবই উঠে
এসেছে। লেখক তাঁর সহমর্মিতার হাত বুলিয়ে গেছেন সেইসব লক্ষ
লক্ষ মেয়েদের প্রতি যাঁরা একই সাথে রোজগার করতে, গৃহকর্ম সামলাতে বৃদ্ধ ও অসুস্থের
সেবা করতে করতে লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হন
নিজের স্ট্রেস, হারিয়ে ফ্যালেন নিজস্ব
অবকাশ। লেখকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ফেলেছে
মেয়েদের সর্বত্রগামী উপস্থিতি, বিশেষত সার্ভিস সেক্টরে, ব্যাংকিং ইত্যাদির
বিভিন্ন পদে মেয়েদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ
কাজগুলোকে করে তুলেছে কম গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েরা সময় দিচ্ছেন বেশী, পয়সা পাচ্ছেন ঢের
কম। এ এক অদ্ভুত অলাতচক্র।
প্রতিটি লেখা ধরে ধরে
বলতে গেলে কথা ফুরাবে না, প্রায় প্রতিটি লেখাই একটি বহমান সময়ে আমাদের মেয়েদের ছোট
ও বড় নানা লড়াই, বদলে যাওয়া কিম্বা পালটে নেওয়ার বিশ্বস্ত দলিল।
‘মেয়েলি’
শব্দটাকে আমরা যারা নিন্দাসূচক জেনে বড় হয়েছি, বড় হতে হতে এর নিন্দার্হ অংশটুকু
বুঝতে না পেরে ক্রুদ্ধ হয়েছি, ক্ষত
বিক্ষত হয়েছি তাদেরই দায়িত্ব বর্তায় এই কথাগুলো বারেবারে জোরেশোরে বিভিন্ন মাধ্যমে
বলবার। যশোধরা সেই দায়িত্বও পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। আমি নিজে চাকরি
শুরু করার সময়ে দেখেছি, অনিতা অগ্নিহোত্রী তাঁর স্মৃতিকথায়ও লিখেছেন মেয়েদের
সর্বদা ‘আরো একটু বেশী’
করে দেখাতে হয়েছে, অফিশিয়াল সিদ্ধান্ত নেবার সময় পুরুষের চেয়ে একটু বেশী পুরুষালী,
বাড়ির কাজে একটু বেশী নিষ্ঠাবতী, যাতে বাইরের জন্য ঘর উপেক্ষিত এমন না ভাবে কেউ।
সেই ‘আরেকটু
বেশী’ থেকে এগিয়ে এসে আমরা
‘না’
বলতে শিখেছি অনেকেই। বলতে শিখেছি আমার শরীর খারাপ বা মন খারাপ আমি পারবোনা সব কিছু
করতে। সবাইকে তুষ্ট করার দায়ও আমরা অনেকে
কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়েছি আলতো করে। এই পরিবর্তন এসেছে আমাদের পূর্বজাদের
তিল তিল করে এগোনর ফলেই। বামাবোধিনী পত্রিকা থেকে খন্ডিতার বিশ্বদর্শনে পৌঁছানো এক
লম্বা যাত্রাপথ। আশাপুর্ণা, কবিতা, নবনীতা থেকে অনিতা, যশোধরারা আমাদের এই যাত্রা
লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যাচ্ছেন আন্তরিকতা ও
নিষ্ঠার সাথে। এই সমৃদ্ধ বহমান ধারার মধ্যেও খন্ডিতার বিশ্বদর্শন মেধা ও মননের
দীপ্তিতে অতি উজ্জ্বল এক মণি। এ বই একবার পড়ে তাকে তুলে রাখার নয়, অন্তত আমার মত
মানবীবিদ্যায় আগ্রহীদের জন্য একেবারেই নয়। বারেবারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক একটা জায়গা নিজের সাথে মিলিয়ে নেবার, ফিরে পড়বার বই।
বই - খন্ডিতার বিশ্বদর্শন
লেখক -
যশোধরা রায়চৌধুরী
প্রকাশক -
সৃষ্টিসুখ ; প্রকাশ –
জানুয়ারী ২০২২
দাম –
২৯৯/- (পেপারব্যাক সংস্করণ)
No comments:
Post a Comment