এইখানে এলে আজকাল আমার কেমন যেন ঝিম ধরে, ঘুম ঘুম পায় আর খুব গরম লাগে,
কেমন যেন দমচাপা| মানুষগুলো সব একই চক্করে
ঘুরেই চলেছে তার আর আগেও নেই পিছেও নেই| দাদা অবশ্য বলে 'ও তুই ওখানে বড্ড পরিশ্রম
করিস তো, তাই এখানে এলে শরীর এলিয়ে দেয়', আর বাবা হিসহিসিয়ে বলে 'ঘরের কোনো টান নেই
তাই এইসব কথা, এই ছুতোয় যতটা বাইরে থাকা যায়'
দাঁত নেই তাই দাঁত কিড়মিড়াতে না পেরে কথাগুলো অমন হিসহিসিয়ে বেরোয়| আমি ভাল
করে দেখি বাবাকে, রোগা হতে হতে হাড় জিরজিরে, খসখসে কোঁচকানো চামড়া, ছানিপড়া চোখ, দাঁতবিহীন
তোবড়ানো গাল,জরার সবকটি লক্ষণ একেবারে চীৎকার করে জানান দিচ্ছে সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ
থেকে| শুধু জিহ্বা আর কন্ঠস্বর একইরকমভাবে দাপট দেখায়, যেমন দেখাত আজ থেকে দুই, পাঁচ,
দশ, পঁচিশ বছর আগে| দাপট বড় ভাল জিনিষ| যতদিন
হাড্ডিগুলো শক্তপোক্ত আর মাথাটা ঘাড়ের ওপরে খাড়া থাকে, যতদিন আঙুল তুললে আঙুল একটা
আর্টেক্স পেনের মত খাড়া হয়ে থাকে, ততদিনই|
এখন যখন মাথা ঘাড়ের ওপরে অল্প অল্প দোলে , আঙুল তুললে হাওয়ায় আঁকা হয় অদৃশ্য
আখর, ভেঙে যাওয়া গলার স্বরে, মাথার দোলনে দাপটকে লাগে কার্টুনসম| তবু অভ্যাসে দাপট হাঁ করতে চায়, থাবা বাড়াতে চায়,
আর ডুবে যেতে থাকে ধুসর শুন্যতায় ---- সে বড়
করুণ দৃশ্য রে বাপ|
দাদার জন্য এই বাড়ীতে একটা ঘর বরাদ্দ থাকলেও আমার জন্য কোনও ঘর নেই,
বাবার ঘরেই শুতে হয় আমাকে| ওপরের তলায় একটা ঘর অবশ্য আছে, তবে তাতে ভাঙা বাক্সপ্যাঁটরা,
পুরানো শিশিবোতল আর রাশি রাশি জাবদাখাতা ডাঁই হয়ে থাকে, একটা মিটমিটে বাল্বও আছে ব্যাস!
সেখানে বড়জোর কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে ফোনে কথা
বলা চলে| আজ পনেরো বছরেরও বেশী আমি বাড়ীছাড়া, আসি ঐ বছরে একবার কি দুইবার,দাদা অবশ্য
নিয়ম করে বছরে তিনবার আসে| খুব শীতে, খুব গরমে আর পুজো কিম্বা কালীপুজোয়| এবারের ব্যপারটা
অন্য, বাবা নাকি পোস্টাপিসের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিল, লোকজন তুলে ড্রিম হেলথ নার্সিংহোমে নিয়ে গেলে সেখানকার ডাক্তারবাবু
ফার্স্ট এইড দিয়ে বাড়ী নিয়ে যেতে বলেন| পাড়ার লোকজনই দাদাকে খবর দেয়, দাদা আমাকে| দাদারা
পরের দিনই এসে গেছে, আমার কয়েকদিন দেরী হল আসতে| যা শুনলাম ডাক্তার সন্দেহ করছেন ছোট্ট
একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে, অন্তত একটা সিটি স্ক্যান করে দেখা দরকার মাথার অবস্থা এখন কী,
কিন্তু বাবা তাতে রাজী নয়| রাজী নয় বললে খুব নরমভাবে বলা হয় কথাটা, আসলে স্ক্যানের
কথা শুনলেই বাবা প্রচন্ড রেগে উঠছে, হিংস্র হয়ে উঠছে, বাবার ধারণা হয়েছে সবাই বাবার
নামে 'পাগল'বলে ফিসফাস করছে, ষড়যন্ত্র করছে| কোনওরকম চিকিৎসায় রাজী নয়|
দাদাটা আমার একটু ভালমানুষ গোছের, ওকে খুব জোর দিয়ে কিছু বললে আর তার
কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না, অন্যায় জেনেও অনেককিছু মেনে নেয়| ঐজন্যই বাবার দাপট চিরকালই
দাদা মেনে এসেছে আর বাবাও তাতে বেশ খুশী, গর্বিতও| নিজের মতামত রোডরোলারের মত দাদার
ওপর দিয়ে চালিয়ে গেছে বাবা, শুধু পারে নি দাদার এই বাড়িছাড়াটা ঠ্যাকাতে| দায়টা অবশ্য
টিপিক্যাল বাঙালি অভ্যাস অনুযায়ী বৌদির ঘাড়েই চেপেছে| আমরাও কেউ পারি নি বাবাকে এই
জায়গা থেকে একদিনের জন্যও নড়াতে| কোনও বোঝানো, ধমক, আত্মীয় বা প্রতিবেশীদের উপদেশ কিছুই
বাবাকে টলাতে পারে নি| অসুখ বিসুখ সম্পর্কে বাবার একধরণের কুসংস্কার আছে, অসুখ হওয়াটাকে
মনে করে খুব হীন একটা ব্যপার, যেন বা প্রায় চুরি ছ্যাঁচরামির মত| আমাদের ছোটবেলায় অসুখ
হলেই বাবা প্রথমে বকাবকি পরে গালিগালাজ শুরু করত| এখন নিজের বেলায় যতটা পারে লক্ষণগুলি
ঢেকে রাখার চেষ্টা করে, খুব বেড়ে উঠলে বাড়ীতে কাজ করে যে ডলিমাসী তার পরামর্শে টোটকা
করে কিম্বা ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খায়| আর কোনওভাবে যেন আত্মীয় বা প্রতিবেশীরা জানতে
না পারে তার চেষ্টা করে| এবারে পাবলিকলি কেৎরে পড়ায় মনে হয় ইগোতে খুব লেগেছে, ঐজন্যই
হয়ত অমন হিংস্র হয়ে উঠছে| আমি এর আগে বেশ কয়েকবার চীৎকার চেঁচামেচি করে ডাক্তারের কাছে
নিয়ে গেছি| এবারে দাদাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে চেষ্টা করছে, আমার কেমন ঝিম লাগে খালি|
আমাদের ছুটি ফুরিয়ে আসে, কোনওমতে একজন ডাক্তারকে বাড়ী এনে দেখানো হয়,
রুটিনমাফিক কিছু টেস্ট| ডলিমাসিকে দিয়ে বৌদি বাথরুমটা ঘষায়, ব্লিচিং ঢালে| বাবার তাতেও
খুব রাগ, নাকি বৌদি আসলে বাবাকে 'নোংরা' বলছে| আমি ছাদের তারগুলো টেনে ঠিক করি, বইয়ের
আলমারিগুলো ঝেড়ে দিই, আমার স্কুলে প্রাইজ পাওয়া দুই একটা বই দেখি এখনও সেরদরে বিক্রী
করে নি| একবার লোভ হয় নিয়ে যেতে, আবার কেটে
যাওয়া শিকড়ের গোড়া থেকে হু হু ছুটে আসে উদাসীন হাওয়া, মুছেটুছে রেখে দিই তাকে| আমরা
দুজনে একে তাকে ধরে, দেওয়ালের গায়ে বিজ্ঞাপন আটকে, ওএলএক্সে দিয়ে অবশেষে
চলে আসার হপ্তাখানেক আগে একজন রান্নার মাসিকে ঠিক করি| আমরা ডলিমাসি আর রান্নামাসিকে
বুঝিয়ে দিই বাবাকে কী কী খেতে দেওয়া যাবে আর কী কী একদম বাদ| রান্নামাসি সেইমত রান্না
করতেই আবার ঝামেলা শুরু হয়ে গেল, বাবার ধারণা
বাবাকে রুগী দেখানোর জন্যই এরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে| কিন্তু 'রুগী' হিসেবে দেখালে আমাদের ঠিক লাভটা কোথায় এই প্রশ্নের
কোনও সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে না পেয়ে শেষপর্যন্ত বলে এই সবই হল আমাদের স্ট্যাটাস দেখানোর
চেষ্টা|
দাদারা চলে যায়, দুদিন পর আমি| শ্যাওলাধরা বাথরুমের মেঝেয় একবার পা পিছলায়,
সামলে নিতেই ওখানকার শুকনো খটখটে বাথরুমটার কথা মনে পড়ায় একটা স্বস্তির শ্বাস পড়ে|
বাবা একবার জানতে চায় এদিকে ট্র্যানসফার হওয়ার
কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা, নাঃ আমাদের ফিল্ডে এদিকে কোনও চাকরিই নেই, সেকথা স্পষ্টই জানাই|
নিভে আসা চোখ আরও একটু নিভে যায় হয়ত| আমরা ছিলাম ক'দিন বাবা বাড়ি থেকে বেরোয় নি| এরপর?
পোস্টাপিস কিম্বা ফার্মেসি? গাড়ী এসে গেছে, ডাফল ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসি,
একবারও পেছনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হয় না, গাড়ী ছেড়ে আসে চেনা রাস্তা, পুকুরঘাট, পালংশাক
আর ধনেপাতার ছোট খেত, অরবিন্দ পাঠাগার, দুর্গাবাড়ী --- আস্তে আস্তে ঝিমধরা ভাব কাটতে
থাকে --- ডোমেস্টিক লাউঞ্জে বসে বেশ চনমনে লাগে --- ট্যাব বের করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফীর
সাইট খুলে ডুবে যাই অরোরা বোরিয়ালিসের ছবিতে, সেই লীলা আর অপু দেখতে যেতে চেয়েছিল|
মাঝ আকাশে একবার মনে পড়ে ঐ ছোট্ট ঘুপচিমত বাড়ীটার কথা --- এতক্ষণে সমস্ত পাড়াও নিশ্চয় শুনশান হয়ে গেছে --- রান্নার
মাসি বিকেলে আসে না, ডলিমাসি চলে গেছে সাড়ে চারটের মধ্যেই --- চাপ চাপ অন্ধকার নেমে
এসেছে বাড়ীটার ওপরে, বাবার ওপরে|
No comments:
Post a Comment