এইমাসে প্রথমেই একটি বই আবার ফিরে পড়লাম৷ বইটি "লালবাতির নীল পরিরা' -- কৃষ্ণা দত্ত -- আনন্দ পাবলিশার্স। এছাড়া আর যে দুটি বই পড়ে শেষ করলাম তা
'পরিবেশের জাতপাত' -- মোহিত রায় -- গাঙচিল আর 'পূর্ববঙ্গীয় কথ্য ভাষা' -- কোরক সাহিত্য পত্রিকা -- প্রাক শারদ সংখ্যা৷
লালবাতির নীল পরিরা :
কৃষ্ণা দত্ত মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। ইংরাজী ও বাংলা দুই ভাষাতেই লেখালিখি করেন। "লালবাতির নীল পরিরা' বইটি লিখতে চেয়েছেন যৌনকর্মীদের বক্তব্য তাঁদের নিজস্ব ভাষায় ধরে রাখার জন্য, ডকুমেন্টেশানের উদ্দেশ্যে।
বইয়ের ভূমিকায় লেখা আছেঃ "এই বইয়ে লালবাতির নীল পরিরা আপনাদের অনেক গল্প শোনাবে। গল্পের টানে আমি চেয়েছি এক প্রাচীনতম বৃত্তির কথা সংস্কারহীনভাবে আপনাদের কাছে তুলে ধরতে। বাস্তবতা বঞ্চনা, চোখের জল, শরীরের খেদ এবং সেই সঙ্গে সমাজের দেশের বিবর্তনের অলিগলি চোরাপথে একধরনের অপরিবর্তিত থাকার ঝোঁককে তুলে ধরতে। এই বই গল্পের মিছিল, কিন্তু সব গল্পের প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনা সত্য। প্রয়োজন মত নাম অদলবদল করা হয়েছে এই যা।' আরো লেখা আছে " ..... আমি কোন পক্ষ নিয়ে লিখিনি, চেষ্টা করেছি নির্মোহভাবে, কখনও বা সাংবাদিকতার শর্ত মেনে আবার কখনও ইতিহাস পুরাণের বিনীত ছাত্রী হিসাবে বিষয়টি দেখার।"
তো, ভূমিকাটি পড়ে মনে আশা জাগে এক বিরাট পটভূমির, বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের, যেখানে অনিচ্ছায় বা স্বেচ্ছায় প্রান্তবাসী হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ তাঁদের বক্তব্য রাখবেন। তথ্য পেশের সাথে সাথে থাকবে হয়ত বা কিছু বিশ্লেষণও।
সূচীপত্রে অধ্যায়সমূহ দেখছি
প্রাচীনকালের রূপাদাসী
তিলোত্তমা কলকাতা
নিষিদ্ধ পল্লী
জোড়াবাগান
ওয়াটগঞ্জ
সোনাগাছি
উড়ান যোনকর্মী, মধ্যবিত্ত যৌনকর্মী
মাফিয়া
লন্ডনের ললনা
উপসংহার।
সূচীপত্র দেখে আশা জাগে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেরও কিছু চিত্র হয়ত পাওয়া যাবে। বইটি আশা পূরণে কতটা সক্ষম, তা এরপরে দেখার চেষ্টা করব।
বইটির প্রথম অধ্যায়ে অতি প্রাচীনকাল থেকে কিভাবে নারীমাংস ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, তা দেখানো হয়েছে। অল্প কয়েকপাতার মধ্যেই লেখিকা দেখিয়েছেন রূপাদাসীরা কেমন অবাধে বণ্টিত হতেন - হিন্দু দায়ভাগ আইনে পরিস্কার করে বলা আছে ওয়ারিশদের মধ্যে কিভাবে স্থায়ী সম্পত্তির সাথে সাথে ক্রীতদাসীদেরও বণ্টন করা হবে। ক্রীতদাসী, যাদের গৃহকর্মের সঙ্গে গৃহপুরুষদের যৌনসেবাও করতে হত। এখানে মোটামুটি বৈদিক যুগ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত সময়কে সংক্ষেপে ধরা হয়েছে।
পরবর্তী দুটি অধ্যায়ে কলকাতার বিভিন্ন নিষিদ্ধ পল্লী কিভাবে গড়ে উঠল, এবং সেখানকার কিছু বাসিন্দার কথা, তাদের নামসহ প্রকাশিত। প্রকাশিত কাহিনীগুলি তাদের ভয়ংকর
রূঢ়তা দিয়ে পাঠককে হতচকিত করে দেয়। জানতে পারি ৯ বছরের মেয়েকে এনে কিভাবে সরষের তেল ও মোমবাতি সহযোগে ব্যবসায় নামাবার জন্য "তৈরী করা" হয়। জানতে পারি নিষিদ্ধ পল্লী থেকে পালান মেয়েরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লে, ঠাঁই হয় লিলুয়া হোমে। সেখানে কিছুদিন থাকলে, অনেকেই নিজেরাই আবার ফিরে আসে নিষিদ্ধ পল্লীতে। নরকেরও কম্পারেটিভ, সুপারলেটিভ ডিগ্রী হয়।
রূঢ়তা দিয়ে পাঠককে হতচকিত করে দেয়। জানতে পারি ৯ বছরের মেয়েকে এনে কিভাবে সরষের তেল ও মোমবাতি সহযোগে ব্যবসায় নামাবার জন্য "তৈরী করা" হয়। জানতে পারি নিষিদ্ধ পল্লী থেকে পালান মেয়েরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লে, ঠাঁই হয় লিলুয়া হোমে। সেখানে কিছুদিন থাকলে, অনেকেই নিজেরাই আবার ফিরে আসে নিষিদ্ধ পল্লীতে। নরকেরও কম্পারেটিভ, সুপারলেটিভ ডিগ্রী হয়।
পরবর্তী ৩ টি অধ্যায়ের নাম থেকেই বোঝা যায়, সেইসব অঞ্চলের যৌনকর্মীদের মুখ থেকে শোনা কথা লিখেছেন। লেখিকা এইসব অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য দূর্বারের সাহায্য নিয়েছেন, ফলে তাদের কথা এসেছে বহুবার। কোথায়ও কোথায়ও প্রায় বিজ্ঞাপনের মত লাগে।
এর পরের অধ্যায়টির নামেই আমি ধন্ধে পড়ি। "মধ্যবিত্ত যৌনকর্মী" বলতে লেখিকা কী বোঝাতে চেয়েছেন? এতক্ষণ পর্যন্ত যতজনের কথা পড়েছি, তার মধ্যে উচ্চ বা মধ্যবিত্ত খুবই কম, শুধু "আগ্রাওয়ালি" ছাড়া আর নেই। অধিকাংশই নিম্নবিত্ত যৌনকর্মী। লেখিকা এখানে দুজন মধ্যবিত্ত গৃহবধুর কথা বলেছেন, যাঁরা সপ্তাহের কিছুটা সময় যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করেন। আগে এর তার মুখে শুনেছিলাম, এই বইয়েও দেখলাম, বাচ্চার "ভাল স্কুল'এ পড়ানোর খরচ যোগাতে অথবা বৈচিত্র্যের সন্ধানে অনেকেই আসেন এই পেশাটিতে। এতক্ষণ পর্যন্ত দেখে এসেছি মূলতঃ আমাদের দেশের দারিদ্র্য, কৌলিন্যপ্রথা ও জাতপাতের বিভেদের কারণেই মেয়েরা বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে নিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ আইনে যৌনকর্মীদের দাগী অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই অধ্যায়ে দেখছি নিরুপায় হয়ে নয়, বরং স্বেচ্ছায় মেয়েরা আসছে!!
"মাফিয়া" অধ্যায়টিতে তেমন কিছুই বলা হয় নি। আলাদা একটি অধ্যায় না করলেও কোন ক্ষতি ছিল না। অন্যত্র যৌনকর্মীদের গল্প বলতে গিয়ে মাফিয়াদের কথা বহু জায়গায়ই এসেছে। এই অধ্যায়টি বইট্টিতে বাড়তি কোন মাত্রাই যোগ করে নি।
আন্তর্জাতিক যৌনকর্মীদের কথা কিছু জানা গেল। খুব একটা সুসংবদ্ধ নয় এই অংশের লেখা। লন্ডন ও প্যারিসের কিছু মহিলার কথা জানা গেল। সমগ্র বিশ্বে যৌনকর্মীদের সমস্যার একটি কমন উৎস হল পুলিশ। সহজে পয়সা তোলার জন্য, কেস দেবার জন্য সমস্ত দেশের পুলিশই যৌনকর্মীদের বেছে নেয়। সব সমাজে এঁরা ঘৃণিত হওয়ায় এঁদের ওপরে জুলুম করা সহজ। সংঘবদ্ধ হওয়াই তাদের ঠ্যাকানোর একমাত্র উপায়।
বইটিতে বিশ্লেষণ আরো একটু থাকলে ভাল হত। সব জায়গায় নিরপেক্ষ কথকের ভঙ্গীটিও বজায় থাকে নি। আরো একটি কথা মনে হল, লেখাগুলি লিখে ফেলবার পর লেখিকা কি কথকদের দিয়ে আরেকবার যাচাই করে নিয়েছেন? ঠিক এই কথাগুলিই তাঁরা বলতে চান তো? খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছি না।
পরিবেশের জাতপাত :
সবাই চায় সুন্দর পৃথিবী, সবুজ অরণ্য, নীল আকাশ, দূষণহীন পরিবেশ৷ টিভিতে, খবরের কাগজে বা এনজিওদের প্রচারপত্রে পরিবেশ ও উন্নয়নের পবিত্র আহ্বান৷ এ সবের ঢক্কানিনাদে ঢাকা পড়ে যায় গরিব মানুষের পরিবেশ সমস্যার কথা৷ হারিয়ে যায় তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের চেষ্টা৷ পেশায় পরিবেশ উপদেষ্টা মোহিত রায় জোরগলায় জানান পরিবেশেরও জাতপাত আছে৷সারাদিন রোদে পুড়ে জলে ভিজে যে নারী সুন্দরবনে মীন ধরেন, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়লে তাঁর কোন লাভই নেই, বরং ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে৷ গ্রাম থেকে আসা এক ছাত্রী তাঁকে বলেছিল বিশেষ কোন জীববৈচিত্র্য ছাড়াই যদি তাঁরা কলকাতা শহরে ওদের চেয়ে অনেক বেশী ভাল থাকেন, তাহলে ওদের গ্রামেই বা কেন জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে? খুব একটা সন্তোষজনক উত্তর যোগায় নি তাঁর মুখে৷ অনেক পরিবেশবিদ যখন পরিবেশের উপর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন, তখন এটা ভুলে যান যে আমাদের দেশের সব ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছতে হলে আমাদের এখনও আরও অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে৷ব্যপারটা অনেকটা যে চারবেলা পর্যাপ্ত খাবারই যোগাড় করতে পারে না, তাকে ডায়েটিঙের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর মত৷
এই বইটি মোহিত রায়ের প্রবন্ধ সংকলন৷ এতে মোট ১৭টি প্রবন্ধ আছে৷ প্রতিটি প্রবন্ধই সুলিখিত ও তথ্যসমৃদ্ধ৷ পরিবেশের দোহাই দিয়ে গরিব উৎখাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং হেরে যাওয়ার কিছু ঘটনারও বিস্তৃত উল্লেখ আছে৷ যেমন রবীন্দ্রসরোবর বা সাউথ সিটির ঘটনা৷সব মিলিয়ে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি প্রবন্ধ সংকলন৷
'পূর্ববঙ্গীয় কথ্য ভাষা' -- কোরক সাহিত্য পত্রিকা -- প্রাক শারদ সংখ্যা :
কোরক পত্রিকার এই সংখ্যাটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্য ভাষার স্বরূপ সংগ্রহ করেছে৷ বইটি মোটামুটি তিনটি অংশে বিভক্ত বলা যায়৷ প্রথম অংশে বাংলাদেশের জেলাগুলিতে মানুষের ব্যবহৃত মুখের ভাষার চেহারা ও চরিত্র অনুসন্ধান করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় অংশে রয়েছে বিভিন্ন লেখকের উদ্ভাবিত শব্দ, সাহিত্যে ব্যবহৃত ভাষা বিষয়ে তথ্যনিষ্ঠ আলোকপাত৷ রবীন্দ্রনাথ থেকে বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ পর্যন্ত বহু কবি, গদ্যকার সচেতনভাবে বহু শব্দ সৃষ্টি করেছেন৷ সেইসব সৃষ্ট শন্দ, ব্যবহৃত ভাষা শুধু বাংলা সাহিত্যে বৈচিত্র এনেছে তাই না, আমাদের আভিধানিক পরিসরেরও বৃদ্ধি ঘটিয়েছে৷ তারই বিস্তৃত বিবরণ উঠে এসেছে এই অধ্যায়টিতে৷ তৃতীয় অংশটি বঙ্গীয় শব্দকোষপ্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর একটি ক্রোড়পত্র৷
আমার ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতীয় অংশটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে৷ এই অংশে রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন এটা প্রত্যাশিতই ছিল৷ কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী, দীপ্তেন্দ্রকুমার, তারাশঙ্কর এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তর শব্দ ও ভাষাশৈলী নিয়ে আলোচনাগুলি নতুন আলোকপাত করেছে৷ এছাড়া মধুসুদন দত্ত, নজরুল, অবধুত, জীবনানন্দ, বনফুল ইত্যাদির ওপর লেখাগুলিও বেশ৷ ,
বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ্য অংশটিতে সংকলিত হয়েছে অমিতাভ চৌধুরী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, দেবাঙ্গন বসু, পরিমল গোস্বaমী ,নির্মল দাশ ও নির্মলকুমার নাগের লেখা ছয়টি প্রবন্ধ৷ সাথে বাড়তি পাওনা রয়েছে বিশ্বভারতী পত্রিকায় ১৩৫৬ সনে প্রকাশিত বঙ্গীয় শব্দকোষের একটি বিজ্ঞাপন৷
কোরকের এই সংখ্যাটি নি:সন্দেহে সংগ্রহযোগ্য৷
No comments:
Post a Comment