খোঁজাখুঁজি

Saturday, March 31, 2012

রান্নাবান্না সহজ নয়

'নারিকেল ভোজনে অহিত যদি হয়, তন্ডুলেতে উপশম জানিবে নিশ্চয়
আম্রফলে দুগ্ধে ঘৃতে জামীরের রস কদলীর ফলে ঘৃত পাচক সরস

"কাঁঠালে কদলী ফল, কদলীতে ঘৃত ঘৃতপাকে জম্বুরস জীর্ণমতে ধৃত

জামরস বিগুণে লবণ প্রতিফল বিঘ্নকর লবণে তন্ডুলধৌত জল



রান্নার বই সংগ্রহের একটা ঝোঁক আমার আছে, শুধু নানারকমের র্সিপির জন্যই নয়, রন্ধনপদ্ধতি থেকে লেখক/লেখিকার সময় ও সমাজটাকেও একটু একটু ধরা যায় বলে| এইজন্য যখন দেখলাম সবুজ  কাপড়ে বাঁধানো বইয়ের উপরে সোনালি অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে 'বাংলা ভাষার প্রথম দুটি রান্নার বই' তখন আর একটুও না ভেবে কিনে নিলাম| একই মলাটের মধ্যে দুটি বই 'পাকরাজেশ্বর' ও 'ব্যঞ্জন রত্নাকর'| প্রকাশক সুবর্ণরেখা|

১৮৩১ সালের ১লা অক্টোবর 'সমাচার দর্পণ'এ 'নুতন গ্রন্থ' শিরোনামে 'পাকরাজেশ্বর'এর আবির্ভাব ঘোষণা করা হয়| বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশন প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে বইটির উৎস "শ্রীযুক্ত বিক্রমাদিত্য মহারাজাধিকারে সংস্কৃত সুপশাস্ত্র সংক্ষেপে সংগ্রহর্ক্ত্তা শ্রীযুত ক্ষেমশর্ম্মাকৃত ক্ষেমকুতুহল নামক গ্রন্থ হইতে ও শ্রীযুত শাহজাহান বাদশাহের  নিত্যভোজনের নেয়ামৎখান নামক পারসীয় পাকবিধি ও নওয়াব মহতাব জঙ্গের নিত্যভোজনের পাকবিধি হইতে সাধারণের দুস্কর পাক পরিত্যাগপূর্ব্বক সুলভ পাক যাহা অনায়াসে সম্পন্ন হয় তাহা গ্রহণ করিয়া ও বর্ত্তমান অনেকানেক সুপকুশল ব্যক্তিদের নিকট জ্ঞাত বিষয়ি ব্যক্তিসকলের সুগম বোধার্থ পরিমাণসহ পাকবিধি"ই এই বইয়ের প্রতিপাদ্য|অর্থাৎ বইটিতে প্রাচীন হিন্দু রান্নার সাথে দিল্লির বাদশাহী রান্নাই শুধু নয়, বর্ধমানরাজের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও পরিবেশিত হয়েছে| তবে লেখক রাজানুকূল্য লাভ করলেও তাঁর লক্ষ্য শুধু একজন রাজাবাহাদুর নন; 'বিষয়ি ব্যক্তিসকল'; অর্থাৎ উচ্চবিত্ত বাঙালী ভদ্রজন| সেইজন্যই তিনি বর্ধমান রাজ ছাড়াও 'অনেকানেক সুপকুশল' ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করেছেন| কিন্তু কে এই লেখক? সমাচার দর্পণে তার কোনও উল্লেখ নেই| অন্যত্র লেখকের নাম 'গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ' বলে উল্লেখ করা হয়েছে| যেমন রেভারেন্ড লঙ তাঁর ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত বাংলা বইয়ের তালিকায় 'বিবিধ' পর্যায়ে বইটি নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন| বলেছেন ১৮৫৪ সালে বর্ধমান রাজের পৃষ্ঠপোষণায় গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন; পৃষ্ঠাসংখ্যা ৯৩; দাম আট আনা| লঙ বলেছেন -- ভাত, সবজি, মাছ, ডিম ইত্যাদি রান্নার যে প্রণালী বইটিতে বিবৃত সেগুলি শুধু যে আঠারোশো বছরের পুরানো তাইই নয়, অনায়াসে ফরাসী রন্ধনশিল্পের সাথে পাল্লা দিতে পারে| বর্তমান সংকলক ও প্রকাশক  আরও অনুসন্ধান ও কিছু সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি ইত্যাদি কচকচির পর আমাদের জানাচ্ছেন যে প্রথ্ম বইটি লিখেছিলেন বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কার| পরে বইটির পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণটি রচনা করেন গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ| তারমানে এইসময় আর শুধুমাত্র তর্ক ও ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা করে পন্ডিতদের দিন চলছিল না, তাই তর্কালঙ্কার, তর্কবাগীশগণ রন্ধনশিল্পের দিকে মন দিয়েছেন| 



এই গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ বেশ ইন্টারেস্টিং চরিত্র| ইনি রাজা রামমোহন রায়ের সাথে তাঁর সহকারী হয়ে ছিলেন কিছুদিন, পরে রামমোহনের বিরোধীদলে যোগ দেন| ধর্মসভার সভাপতি নন্দলাল ঠাকুরের প্রায় ডানহাত ছিলেন গৌরীশঙ্কর| এইসময় শোভাবাজার রাজবাড়ীর সভাপন্ডিত হিসাবে রাজবাড়ী থেকে মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পেতেন তিনি| 'সম্বাদ ভাস্কর' এর সম্পাদক হিসাবে কাগজে কলমে শ্রীনাথ রায়ের নাম থাকলেও আসল সম্পাদক ছিলেন গৌরীশঙ্কর| 'সম্বাদ রসরাজ' নামে একটি কাগজও তিনি প্রকাশ করেছেন| কুরুচিপূর্ণ লেখা ও অশ্লীলতার জন্য কাগজটি একাধিকবার দন্ডিত হয়, গৌরীশঙ্করকে কারাদন্ডও ভোগ করতে হয়| 


পাকরাজেশ্বর প্রকাশের ২৭ বছর পর এবং গৌরীশঙ্কর কর্তৃক দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের চার বছর পর বর্ধমান রাজবাড়ী থেকে আরেকটি বই প্রকাশিত হয় --- 'ব্যঞ্জন রত্নাকর'| বইটির নামপত্রে বলা হয়েছে 'বর্দ্ধমানাধিপতি শ্রীল শ্রীযুক্ত মহতাবচন্দ্র/বাহাদুরের অনুমত্যনুসারে ও ব্যায় দ্বারা/ মুনসী শ্রীমহম্মদী, শ্রী গোলাম রব্বাণী ও তারিণীচরণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং শ্রী শ্রী নরনারায়ণ হাজরা কর্তৃক নেয়ামৎ/খান পুস্তক হইতে অনুবাদিত হইয়া কলিকাতার তত্ত্ববোধিনী সভার যন্ত্রে মুদ্রিত হইল| সম্ভবতঃ এই বইটির একটিই সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল| ব্যঞ্জন রত্নাকর বইটির বেশ কিছু অংশ পর্যন্ত মাংস ছাড়া নয় কিছু রান্নার উল্লেখ দেখা যায় না, 'আষ পাক প্র?ণালী' বলে কয়েক পাতার একটি অধ্যায় থাকলেও সেখানে কেবলই মাংসের বিভিন্ন পদ| প্রথম মাছের দেখা পাওয়া যায় 'কালিয়া পাকারম্ভে'| মাছ বলতেও মূলত  রোহিত মৎস্য অর্থাৎ রুই মাছের কথাই রয়েছে|  বর্ধমান রাজবাড়ীর আনুকূল্যে প্রকাশিত দুটি বইতেই ঘিয়ের ছড়াছড়ি| দুই এক জায়গায় তিলতৈল ও ছাগতৈলের উল্লেখ আছে বটে কিন্তু অধিকাংশ রান্নাই ঘিয়ে পাক| যা বুঝলাম বর্ধমান রাজবাড়ীর হেঁসেলে মাংস আর হিয়ের জয়জয়কার| তুলনায় বিপ্রদাশ মুখোপাধ্যায় রচিত (সম্ভবতঃ ১৮৪২) 'পাক প্রণালী'র রন্ধনপদ্ধতি অনেক সহজপাচ্য উপকরণে রচিত| 


যাই হোক আর বকর বকর না করে দুই চারটে রন্ধনপ্রণালী তুলে দিই বরং| 


করেলার শুষ্ক প্রলেহ

-------------------
মাংস - ১ সের
করেলা - ১ সের
ঘৃত - ১ পোয়া
দারচিনি - ৩ মাসা
লবঙ্গ - ১ মাসা
এলাচ - ২ মাসা
মরিচ - ৪ মাসা
পলাণ্ডু - ১ পোয়া
আদা - ১ তোলা
ধনে - ১ তোলা
লবণ - ৬ তোলা
হরিদ্রা - ৩ তোলা
দধি - ১ পোয়া

মাংস খণ্ড ২ করিয়া সঘৃত পলাণ্ডে ভর্জ্জিত পূর্ব্বক বাঘারের পর লবণ ও বাটা ধনে ও আদা অর্পণে উলুতপ্লুত করিয়া সিদ্ধ হওনোপযুক্ত জলে সিদ্ধ করিবার পর করেলার বীজ পরিস্কার মতে হরিদ্রা মাখাইয়া রৌদ্রে রাখিবে ১ দণ্ড পরে হস্ত দ্বারা কচলিয়া তিক্ত রস নির্গত করণান্তে তিন বার নির্ম্মল জলে ধৌত করিয়া দধি মাখাইয়া চারি দণ্ড পরে উত্তম রূপ ধৌতান্তে ঘৃতে ভর্জিত পূর্ব্বক শুষ্ক প্রলেহ সহ পাক করিবে; সুপক্ক হইলে গন্ধদ্রব্য চূর্ণ ও পেষা জাফরান দিয়া নামাইবে।।


হাবশি পলান্ন

------------

মাংস - ১ সের

তণ্ডুল - ১ সের
দাড়িম্বের দানা - ১ পোয়া
ঘৃত - ১ সের
চিনি - ১ সের
সুপারী - ৩ তোলা
দারচিনি - ১ মাসা
এলাচ - ২ মাসা
লবঙ্গ - ২ মাসা
মরিচ - ৪ মাসা
পলাণ্ডু - ১ পোয়া
আদা - ১ . ৫ তোলা
ধনে - ১ . ৫ তোলা
কৃষ্ঞবর্ণ জিরা - ২ মাসা
লবণ - ১ . ৫ তোলা
দ্রাক্ষা - ৩ তোলা
বাতাম্র - ৩ তোলা

প্রথমত: খণ্ড ২ মাংস ধনে পলাণ্ডু আদা লবণ ও জল সহ সিদ্ধ করিয়া জুস বস্ত্রপুত পূর্ব্বক মাংসসহ সঘৃত লবঙ্গে বাঘারের পর মাংস পৃথক করিবে, পরে পাকপাত্রে জিরা ছড়াইয়া তদুপরি মাংস সাজাইবে এবং দাড়িম্বের রস নির্গত পূর্ব্বক সুপারি ভস্ম ও একটা পাতি নিমুর রস মিশ্রিতান্তে মাংস ভবরসে মিশাইয়া ২ চমস মাংসে ক্ষেপণে তাপে শুষ্ক হইলে অর্দ্ধসিদ্ধ তণ্ডুল মণ্ড গালন পূর্ব্বক মাংস ভবরসে সিদ্ধ করিয়া মাংসে ক্ষেপণে একবার তাপের পর ঘৃত দিয়া দম দিবে, আর ভর্জিত বাতাম্র ও দ্রাক্ষা তাহার উপর ছড়াইয়া দিবে।


ছাগাদি মুণ্ড রন্ধন

-------------
মুণ্ড - ১ টি
ঘৃত - ১ সের
তিলতৈল - ১ ছটাক
বেসবার - ১ ছটাক
উদ্বূলন - ১ তোলা
লবণ - ১ ছটাক

দীর্ঘ চিমটায় মুণ্ড ধরিয়া প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে ঝলসাইয়া তপ্তজলে ধৌত করিবে, পরে চটের উপর ঘর্ষণে লোম রহিত করিবে তত্পরে মজ্জা থাকে এমত খণ্ড খণ্ড করিয়া তৈলে বাঘারের পর বেসবার জলে ঘুলিয়া তাহাতে দিবে, সুপক্ক হইলে ঘৃতে সন্তলন পূর্ব্বক উদ্বূলন দিয়া নামাইবে।


মত্স্য ভোর্ত্তা

--------------
মত্স্য - ১ সের
ঘৃত - ১ পোয়া
দারচিনি - ২ মাসা
এলাচ - ২ মাসা
লবঙ্গ - ২ মাসা
মরিচ - ৪ মাসা
আদা - ১ তোলা
পলাণ্ডু - ১ পোয়া
ধনে - ১ তোলা
লবণ - ৩ তোলা

প্রথমত: নিস্তক ও পরিস্কৃত মত্স্য খণ্ড ২ করণান্তে ছুরির পৃষ্ঠভাগ দ্বারা থুরিয়া আদার রস ও লবণ মিশ্রিত পূর্ব্বক ৪ দণ্ডের পর ধনেবাটা মাখাইয়া ৫ তবক কদলীপত্র বেষ্টিত পূর্ব্বক তপ্ত বালুকার মধ্যে পুতিয়া রাখিবে পরে নির্গত করণান্তে ভর্জিত পলাণ্ডুসহ বাঘারে উলুতপ্লুত করিয়া গন্ধদ্রব্য চূর্ণ সংযুক্তে সন্তলন করিবে।।


কিছু পরিভাষা --

উদ্বুলন = এলাচ, লবঙ্গ, কর্পূর, মরিচ, দারুচিনি ইত্যাদি মিশ্র চূর্ণ
বেসবার = ব্যঞ্জন মধ্যগামী হরিদ্রা চূর্ণ মিশ্র মশলা
উলুতপ্লুত - উত্লানো
সন্তলন - সাঁত্লানো
বাতাম্র - বাদাম (কিন্তু চীনে না আমন্ড, সে বিষয়ে কবি নীরব)

No comments:

Post a Comment