খোঁজাখুঁজি

Monday, February 13, 2012

উদারচরিতম


)
বন্ধুমহলে চন্দনের বেশ দরাজদিল বলে নাম আছে৷ যে কোনও সামান্য উপলক্ষ্যেই বন্ধুদের খাইয়ে দেয়, কেউ সাহায্য চাইলে তো কথাই নেই, প্রাণপণে সাহায্য করে৷ চিন্তাভাবনায়ও বেশ উদার প্রকৃতির বলে পরিচিত৷ ওদের গোঁড়া ব্রাহ্মণবাড়ীর কোনও সংস্কারই সে মানে না৷ অহেতুক আচারসর্বস্বতা যে তার দু চক্ষের বিষ এ কথা সে প্রথম আলাপের মিনিট পনেরোর মধ্যেই জানিয়ে দেয় লোককে৷ দুটো এন জি ওর সাথে যুক্ত চন্দন৷ এছাড়াও একটি আধা সরকারি অনাথ আশ্রমেও তার যাওয়া আসা আছে, তাদের বিভিন্ন উদ্যোগের সাথে সক্রিয়ভাবেই জড়িত থাকে৷ চন্দনের দাদা রঞ্জনও অনেকটা এই ধরণেরই, তবে সে কথা অনেক কম বলে৷


অনিতা দেবী যখন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরে বিধবা হন, তখন রঞ্জন দশ আর চন্দন সাত৷ তপোধনবাবু খুবই খরুচে প্রকৃতির ছিলেন, ফলে হার্ট অ্যাটাকে আচমকা তাঁর মৃত্যুর পর ওরা খুবই আতান্তরে পড়ে যায়৷ তবে অনিতা দেবীর কলেজে লাইব্রেরিয়ানের চাকরিটা ছিল বলে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার অভাব হয় নি৷ তপোধনবাবুর দূরসম্পর্কের এক বয়স্ক দু:স্থ দাদা তাঁদের আশ্রিত ছিলেন৷ তপোধনবাবুর মৃত্যুর পর অনিতা দেবী তাঁকে জানিয়ে দেন তাঁর পক্ষে আর ওঁর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হয় না৷ এরপরে তিনি দুই ছেলে ও তাঁর নিজস্ব জিনিষপত্র নিয়ে বাপের বাড়ী চলে আসেন৷

বাপের বাড়ীতে এমনিতে তাঁদের কোনও অসুবিধে হয় নি৷ চন্দনরা দুই ভাইই পড়াশোনায় মোটামুটি ছিল৷ দারুণ কিছু চমকদার রেজাল্ট না করলেও দুজনেই মোটামুটি ভাল নম্বর নিয়ে গ্রাজুয়েশান শেষ করে৷ রঞ্জন বিভিন্ন সরকারী ও আধা সরকারী পরীক্ষা দিতে দিতে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় অফিসার পদে যোগ দেয়৷ চন্দনের অত লেগেবেঁধে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেওয়া ঠিক ধাতে পোষাত না বলে স্পোকেন ইংলিশ আর কম্পিউটার শিখতে শুরু করে৷ বছর তিনেক বাদে সেও একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ পেয়ে পুণে চলে আসে৷ শান্তশিষ্ট ছোট শহরটা চন্দনের বেশ পছন্দ হয়ে যায়৷ মাঝে কিছুদিন অন্য একটা কোম্পানির চেন্নাই ব্র্যাঞ্চে কিছুদিন কাজ করেছে৷ কিন্তু পাহাড়ঘেরা ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ার পুণের আকর্ষণে চাকরী বদলিয়ে আবার ফেরত চলে আসে৷

)
এই শহরটা গত দুই তিন বছরে হঠাত্ ফুলেফেঁপে উঠেছে মুলত: সফটওয়্যার কর্মীদের জন্য৷ আউটসোর্সিঙের ধাক্কায় ভারতের বড়, মেজ, ছোট কোম্পানিগুলো যখন ক্রমশ: হাত পা ছড়াতে শুরু করে, ব্যাঙ্গালোর, বোম্বাইয়ে এক চিলতে অফিসেরও আকাশছোঁয়া দাম হয়ে যায়, তখনই কোম্পানিগুলোর চোখ পড়ে এই ছোট শহরটার দিকে৷ বেশ কিছু ভাল কলেজ, ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি থাকায় বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগও এখানে তেমন কঠিন নয়, আর এদিকে জমিটমিও শস্তাই বলতে হবে৷ইনফোসিস, উইপ্রো, কগনিজেন্টের মত কোম্পানিগুলো একবারে অনেকটা করে জমি নিয়ে ৩৫০০-৪০০০ লোক বসতে পারে এরকম বেশ দু তিনটে করে অফিস শুরু করে৷ ফলে শহরে বেড়ে যায় প্রচুর লোকের আনগোণা৷ প্রয়োজন হয় অজস্র আবাসিক বাড়ী, হোটেল, খাবারদাবারের জায়গা ইত্যাদির৷ দেখতে দেখতে ফ্ল্যাটের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়৷ পুণে-ব্যাঙ্গালোর হাইওয়ের ধারের পাহাড়ী বস্তিগুলো উচ্ছেদ করে করে পাহাড় কেটে কেটে তৈরী হতে শুরু করে ছোট বড় হাউসিং কমপ্লেক্স৷ শহরে বাড়ীভাড়াও হয়ে যায় প্রচন্ড চড়া৷

চন্দন এইসময়ই হাইওয়ের ধারে 'আদিত্য গার্ডেন সিটি' নামের এক লাক্সারি হাউসিং কমপ্লেক্সে ১১০০ স্কোয়্যার ফিটের একটা ফ্ল্যাট কেনে৷ এই কমপ্লেক্সটা পাহাড়ের গায়েই বানানো৷ ফেজ-'এর ৫০০ ফ্ল্যাট একদম সমতলে, ফেজ-'এর ফ্ল্যাটাগুলো অল্প উঁচুতে৷ কমপ্লেক্সের ভেতরে হাঁটতে গেলে বোঝা যায় রাস্তা আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে ওপরে উঠছে৷ প্রতিটা ফ্ল্যাটে তিনটে করে ব্যালকনি থাকায় আলো হাওয়া প্রচুর পাওয়া যায়৷ চন্দন সারাদিন এবং রাতেরও বেশ খানিকটা অফিসে থাকে, ওর বৌও একটা স্কুলে পড়ায়৷ সাড়ে চার বছরের তানিকাকে ক্রেশে রাখাটা ওদের কারও পছন্দ নয়৷ চন্দন তাই মা'কে ওর কাছে নিয়ে আসে৷ রিটায়ার করার পর অনিতা দেবী বাড়ীতে একাই কারণ দাদু দিদিমা মারা যাওয়ার পর মামারাও আর কেউ ওখানে থাকে না আর রঞ্জনেরও পোস্টিং হয়েছে মাথাভাঙায়৷ সেও বছরে বার দুই আসে৷

অনিতা দেবী প্রথমে চেনা পরিবেশ ছেড়ে এতদূরে আসতে চান নি৷ পুণেতে একে তো অচেনা অজানা পরিবেশ, তায় আবার ভাষাটাও জানেন না৷ এদিকে ছেলের কাছে মাঝেমধ্যে শুনেছেন মারাঠীরা সহজে অন্য কোনও ভাষা বলতে চায় না৷ সব মিলিয়ে তাঁর একেবারেই পছন্দ হয় না পুণে যাওয়ার প্রস্তাব৷ কিন্তু চন্দন বুঝিয়ে বলে ওদের আদিত্য গার্ডেনে প্রায় ৩০টা বাঙালী ফ্যামিলি আছে৷ ওরা এবার সেখানে দুর্গাপুজোও শুরু করছে৷ আর বাংলা বই পত্তরও যথেষ্ট পাওয়া যায়৷ সবচেয়ে বড় কথা ক্রেশে থাকলে তানিকাও মারাঠী ভাবধারাই বেশী করে শিখবে, এমনিতেই স্কুলে যথেষ্ট শেখে৷ শেষ পর্যন্ত নাতনীর কথা ভেবেই অনিতা দেবী রাজী হন৷ এসে অবশ্য তাঁর ভালই লেগেছিল জায়গাটা, চন্দনের বাড়ী, চন্দন তনুশ্রীর ব্যবহার, নাতনীর প্রাণোচ্ছলতা৷ অল্প কিছুদিন যেতেই শান্ত নিরুপদ্রব জায়গাটা আর তার না ঠান্ডা না গরম আবহাওয়া তাঁর বড্ড পছন্দ হয়ে যায়৷ ফলত: তিনি যে এখানেই থাকবেন সেটা নিশ্চিত হওয়ায় চন্দন তনুশ্রীও ভারী নিশ্চিন্ত৷


)
আদিত্য গার্ডেনে দুর্গাপুজোর এবারে প্রথম বছর৷ বাঙালী পরিবারগুলো ছাড়াও আবাসিক সকলকেই প্রথম মিটিঙের দিন ডাকা হয়েছিল৷ এই দায়িত্বটা মেনটেন্যান্সের সুমন গোড়বোলেকে দেওয়া হয়েছিল৷ ছোকরা বেশ চালাকচতুর, কাজেকর্মে চটপটে৷ ওকেই মৃত্যুঞ্জয়বাবু আর চন্দন গিয়ে বলে এসেছিল সব ফ্ল্যাটেই যেন আমন্ত্রণ জানিয়ে আসা হয়৷ এমনিতে কমিউনিটি হলটা বেশ বড়৷ প্রত্যেক বছর গণেশ পুজো এখানেই হয়৷ দেওয়ালীর সকালেও এখানেই পুজো হয়৷ চন্দনরা এই সব অনুষ্ঠানগুলোতেই সাগ্রহে অংশ নেয়, তবে কর্তৃত্বের ভার থাকে মনীশ কুলশ্রেষ্ঠ আর অমিত কুলকার্নির হাতেই৷ বাঙালী পরিবাররা সেখানে শুধুই অনুষ্ঠানের দিন আমন্ত্রিত৷ এ নিয়ে বাঙালী পরিবারগুলোর মধ্যে অল্পস্বল্প ক্ষোভ, গুজগুজানি চলেই৷ তাই দুর্গাপুজো করা হবে এটা ঠিক হওয়ামাত্র চন্দন সবাইকে বলে যে বাঙালীরা যেহেতু অনেক বেশী উদার তাই প্রথম থেকে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হোক৷ রঞ্জিত চৌধুরি খুব আপত্তি করেছিলেন এই প্রস্তাবে৷ তাঁর মতে বাঙালীরা বড্ড বেশী বেশী উদারতা দেখায় বলেই অন্যরা এত বেশী পেয়ে বসে৷ সবাইকে ডাকলে মারাঠীরাই শেষে কমিটি দখল করে নেবে৷ দুই পক্ষেই বেশ কিছু মতামত বিনিময়ের পর যখন ব্যপারটা বাদানুবাদের দিকে গড়াতে শুরু করে তখন মৃত্যুঞ্জয়বাবু প্রস্তাব দেন আগেই কমিটি তৈরী করে, সভ্যদের নাম দিয়ে সবাইকে সাধারণ সভায় ডাকা হোক৷ এতে কমিটি দখল হওয়ারও সম্ভাবনা থাকবে না আবার সবাইকে আমন্ত্রণ জানানোও হবে৷

প্রথম সাধারণ সভায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনার মাঝে প্রস্তাব হয় একটা ঢাক বাজান প্রতিযোগীতার আয়োজন করলে কেমন হয়৷ কমপ্লেক্সের ছেলে ছোকরারা তো নাম দেবেই তর সাথে গোটা পুণে শহরে কিছু পোস্টার লাগিয়ে জানানো হবে যাতে বাইরের লোকও নাম দিতে পারে৷ তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যায়৷ এইসময় ডানদিকের কোণ থেকে এক বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে ধীর স্বরে জানান তাঁরও একটি প্রস্তাব আছে৷ পুজোর সময়েই এবারে ঈদ পড়েছে৷ সেইদিন যেন সকল সভ্য তাঁর আতিথ্যে দুপুরের খাবারটা খান৷ সভাটা হঠাত্ই খুব চুপচাপ হয়ে যায়৷ জোড়া জোড়া চোখ বৃদ্ধের আপাদমস্তক মাপতে শুরু করে৷ প্রায় ৩০ সেকেন্ড পরে মনীশ কুলশ্রেষ্ঠ বলে ওঠেন 'জনাব আপকা নাম বাতায়েঙ্গে জারা'৷ বৃদ্ধ ছোট্ট একটি বাও করে বলেন 'খলিল বদরুদ্দিন আহমদ'

প্রথম সভার দিন সভাভঙ্গের পরেও বড় ছোটদলে ভাগ হয়ে বহুক্ষণ আলোচনা চলেছে বিভিন্ন বিষয়ে৷ এর পরেও আরও দুটি সভা হয়েছে, কমিটির লোকজন ছাড়াও কিছু বিশিষ্ট লোককে নিয়ে৷ কী কী প্রতিযোগীতা হবে, চারদিনের খাওয়ার মেনু কী হবে এইসব বিষয়ের সাথে সাথে এখানে একটি মুসলমান পরিবার কবে এবং কীভাবে ফ্ল্যাট কিনল এটাও অন্যতম আলোচ্য ছিল৷ অমিত কুলকার্নি গোঁড়া মারাঠী ব্রাহ্মণ, কোনও মুসলমানকে পুজোর অনুষ্ঠানে দেখতে নারাজ৷ সাফ জানিয়ে দেন খলিল সাহেব মন্ডপে পা রাখলে তাঁর পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয; বাঙালীরা তাদের দেবীকে চাইলে অপমান করতে পারে, কিন্তু তিনি ভগবান গণপতির মায়ের এই অপমান করতে পারবেন না৷ চন্দন, পুস্কর, অনির্বানরা পড়ে মহা ফাঁপরে৷ প্রথমে ডেকে এনে খলিল সাহেবকে পরে আসতে না করতে তাদের লজ্জা করে অথচ অমিত তাউএর কথাও ঠিক, পুজোমন্ডপে ওঁর উপস্থিতির ব্যপারটায় ওদেরও মন সায় দিচ্ছে না৷

)
সপ্তমীর দিন সকাল থেকে অনিতা দেবীর ব্যস্ততার শেষ নেই৷ পুজোর চারদিন যদিও বাড়ীতে জলখাবারের পাট নেই, তবু তানিকার জন্য কিছু করতেই হয়৷ ও বেচারি বেলা সাড়ে ন'টা, দশটা অবধি না খেয়ে বসে থাকতে পারে না, এদিকে পুজোর ওখানে জলখাবার তার আগে হয়েও ওঠে না৷ তাই নাতনীকে খাইয়েই ছুটতে হয় ঠাকুরের ফল কাটাতে, নৈবেদ্য সাজাতে৷ তনুশ্রীদের বয়সী মেয়েরা কেউই নৈবেদ্য সাজানোর নিয়মকানুন জানে না, তাই ওঁরা ছয় বুড়ি এই কাজটা করেন৷ ফল কাটায় অবশ্য অল্পবয়সী মেয়েরাও সাহায্য করে৷ সকলের জলখাবার বানানোর জন্য ঠাকুর আনা হয়েছে, তারাই লুচি আলুরদম করে দেয় আর রাধিকা স্যুইটসের রসগোল্লা তো আছেই৷ রান্নার ঠাকুররা উত্তরপ্রদেশের লোক৷ লুচি বলতে তারা মোটামোটা পুরীই বোঝে৷ চন্দন, পুস্কর, অনির্বানরা ঐদিকটায় নজর রাখে, যতটা সম্ভব বাঙালী ধরণে রাঁধানোর চেষ্টা করে৷ তবে তাদেরও তো আরও কাজ আছে৷ বিকেলে এক একদিন এক একটা প্রতিযোগীতা, তার ব্যবস্থাপনা, রিহার্সাল দেওয়ানো হঠাত্ দরকারে দোকান থেকে জিনিষপত্র আনা৷ একটু বয়স্ক লোকেরা, যেমন মৃত্যুঞ্জয়বাবু, বিজন সরকার, রঞ্জিতবাবু পুরুতমশাইয়ের কাছাকাছি বসে পুজো দেখেন আর নানা বিষয় আলোচনা করেন৷

আজ ঈদ, সকাল থেকে খলিল সাহেবেরও ব্যস্ততার শেষ নেই৷ ঈদের নামাজ পড়তে ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এম জি রোড অঞ্চলে৷ ওখানেই নামাজ সেরে সকলের সাথে কোলাকুলি করে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরেছেন৷ আজ তাঁর বাড়ীতে কমপ্লেক্সের সকলের মধ্যাহ্ণ ভোজনের নেমন্তন্ন৷ আত্মীয় বন্ধুরাও আসবেন প্রথামতই৷ ছেলে আমিনের বন্ধুরাও আসবে৷ এবারে একটা দুম্বা এনেছেন তিনি কোরবানির জন্য৷ রহমত্ দুম্বার মাংস আলাদা করে কেটে কেটে রাখছেন বিরিয়ানি আর কোর্মার জন্য৷ দুটোয় তো আর একরকম পিস হবে না৷ এছাড়া কাছাকাছি আত্মীয়দের বাড়ীতেও একটু করে মাংস দিয়ে আসবেন খলিল সাহেব গিয়ে৷ নাশতা শেষ হতে না হতেই আমিনের বন্ধুরা এসে যায়৷ ওদের সাথে আমিন বেরিয়ে যায় দুপুরের পর ফিরবে জানিয়ে৷ শোলাপুরের কাছে ধারওয়ার গ্রামে খলিল সাহেবদের পাঁচ পুরুষের বাড়ী৷ সেখানে এখন আর কেউ থাকে না৷ কিন্তু ঈদ এলে গ্রামের কথা মনে পড়বেই৷ সেখানকার সেই পুরো গ্রামের প্রায় একটা আস্ত পরিবারের মত ঈদ পালন ---- অনিচ্ছাসত্ত্বেও বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে খলিল সাহেবের৷ হরেকরকম ব্যস্ততায় বেলা বাড়তে থাকে, বেশকিছু বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এসে গেছেন৷ কেউ কেউ অন্য জায়গায় যেতে হবে বলে চলেও গেছেন৷ খলিল সাহেবের একটু অস্বস্তি লাগে, কমপ্লেক্সের কেউ এখনও পর্যন্ত একবারও আসে নি৷ আবার ভাবেন দুর্গামাঈকি পুজা নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত হয়ত, প্রথমবার করছে, কত হয়ত অসুবিধে হচ্ছে৷ মনে মনে ঠিক করেন সন্ধ্যেবেলা গিয়ে মন্ডপে বসবেন, দেখবেন যদি ওদের কোনও সাহায্য লাগে৷ হয়ত ওঁরা ওর সাহায্য নেবে না ---- অতীতের কিছু অভিজ্ঞতা মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারে ---- সেসব জোর করে দূরে সরিয়ে দেন৷ মনকে বলেন, বুড়োরা হয়ত নেবে না কিন্তু এই চন্দন, পুস্কর এরা অন্যরকম৷ চন্দন তো বিশেষ করে খুবই ভাল ছেলে, একদম সাফ দিল৷

বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ চন্দন আর পুস্করকে আসতে দেখে খুশী হয়ে ওঠেন খলিল সাহেব৷কমন করিডরে এগিয়ে যান৷ ওরা কিন্তু আর এগোয় না৷ চন্দন দ্রুতস্বরে জানায় খলিল সাহেবদের আজ নিশ্চয় আজ অনেক পরিশ্রম গেছে, ওরা ওঁদের খাবারটা এখানে দিয়ে যাবে, ওঁদের আর কষ্টকরে মন্ডপে যেতে হবে না৷ এক সেকেন্ডের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলেও ষাটোর্ধ মানুষটি তার পরেই বুঝে যান৷ সামলে নিয়ে ওদের দুজনকে ভেতরে এসে কিছু খেয়ে যেতে বলেন৷ আবারও পুস্কর চুপচাপ, চন্দন তড়বড়িয়ে বলে ওঠে ওদের আজ উপোস, রাত নটার পর দেবীর ভোগ খাবে৷ খলিল সাহেব আর কিছু বলেন না, খুব আবছা একটু হাসেন৷ সকালে ফেরার সময়ে তিনি এই ছেলেগুলোকে কমিউনিটি হলের পাশের রান্নার জায়গায় দাঁড়িয়ে পুরী আর রসগোল্লা খেতে দেখেছেন৷ চন্দন বেরিয়ে এসে পুস্করকে বলে 'যাক ভালোয় ভালোয় মিটেছে ব্যপারটা'৷ অমিত তাউর হুমকীতে সবাই যখন চক্ষুলজ্জা আর উচিত-অনুচিতের টানাপোড়েনে দিশেহারা, তখন বুদ্ধিটা ওরই মাথায় এসেছিল৷ প্রতিদিন ওরা গিয়ে ওঁদের বাড়ী কিছু খাবারদাবার পৌঁছে দিয়ে বলে আসবে ওঁদের যাতে কষ্ট করে না যেতে হয় তাই এই ব্যবস্থা৷

সন্ধ্যেবেলা রীতেশ আর অনির্বান কিছু ভোগ নিয়ে ওঁদের বাড়ী গিয়ে দেখল ফ্ল্যাট তালাবন্ধ করে ওঁরা কোথায় বেরিয়েছেন৷ এর পরের দুইদিনও ওঁদের ফ্ল্যাট সকাল থেকেই তালাবন্ধ দেখা যেত৷ ওঁরা কখনই বা আসতেন আর কখন বেরোতেন কেউই টের পেত না৷ শুধু পার্কিঙে স্করপিওটা দেখা যেত না৷ দশমীর বিকেলে খলিল সাহেব মেইনটেন্যান্স অফিসে গিয়ে সুমনকে জানান তিনি এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিতে চান, সম্ভব হলে আগামী মাস থেকেই৷ সুমন এইসব ভাড়া, কেনা লেনদেন করিয়ে দিয়ে কমিশান নেয়৷ সে প্রচন্ড অবাক হয়ে জানতে চায় 'আপলোগঁ কাঁহা জায়েঙ্গে?' খলিল সাহেব উত্তর না দিয়ে অল্প হাসেন৷ জিগ্যেস করেন কামওয়ালি বাঈ আজকাল কমন করিডরটা নিয়মিত ঝাঁট দেয় না কেন? সুমন আমতা আমতা করে বলে বড্ড কামাই করছে কদিন৷ খলিল সাহেব আবারও একটু হেসে বলেন 'গোড়বোলেসাব নীচেকা অউর উপরকা করিডর লেকিন সাফই হ্যায়'৷ সুমন প্রচন্ড অপ্রস্তুত হয়ে বলে ও কাল থেকে নিজেই নজর রাখবে -- কিন্তু খলিল সাহেব ততক্ষণে বেরিয়ে গেছেন৷

দশমীর দিন চন্দন খুব খুশী৷ ওর অনেকদিনের একটা ইচ্ছে আজ পূরণ হয়েছে৷ বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে অনিতা দেবী কখনও দশমীর দিন মা দূর্গাকে বরণ করতে যান নি৷ ওঁর বাপের বাড়ীতে নিয়মকানুনের খুব কড়াকড়ি ছিল৷ দশমীর সিঁদুরখেলার সময় বিধবা মানুষের সেখানে থাকতে নেই - এই অজুহাতে চন্দনের দিদিমা কোনওদিন অনিতাদেবীকে যেতে দেন নি৷ ফলে দিদিমা গত হওয়ার পরও এক অদৃশ্য বাধা অনিতা দেবীকে দশমীর দিন ঘরে আটকে রাখত৷ অথচ চন্দন কতবার বুঝিয়ে বলেছে এইরকম গোঁড়ামীর কোনও অর্থ নেই, উনি সিঁদুর খেলবেন না ঠিক আছে, কিন্তু ঠাকুর বরণ করতে কি দোষ৷ পাপের ভয়েই হোক কি সংস্কার পালনের দীর্ঘ অভ্যেসের ফলেই হোক অনিতা দেবী কিন্তু যান নি৷ আজ এই আদিত্য গার্ডেনের পুজোর দশমীতে চন্দনের মা'ও বেরোন অন্যদের সাথে ঠাকুর বরণ করতে৷ মিষ্টি, টাকা, পান, সিঁদুর দিয়ে বরণ করেন৷ তনুশ্রী ঠাকুর বরণ করে ওঁকে প্রণাম করলে উনি থালা থেকে সিঁদুর তুলে তনুশ্রীর সিঁথিতে, কপালে পরিয়ে হাতের শাঁখায়ও ছুঁইয়ে দেন৷ পরে আরও এয়ো মেয়ে বউদেরও দেন৷ আনন্দে চন্দনের চোখে জল এসে যায়, পেরেছে ও পেরেছে৷ এতদিনের অন্ধ সংস্কার ও বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভাঙতে পেরেছে৷ আরে ওরা বাঙালী --- স্বভাবতই উদার, এ কি আর গোঁড়া মারাঠী নাকি! আর পুজো মানে তো শুধুই ঠাকুর পুজো নয়, একটা মিলনমেলা, সবাইকে নিয়ে আনন্দ উত্সব৷

দশমীর দিনই চন্দনকে দুর্গাপুজো কমিটির স্থায়ী সেক্রেটারি হিসাবে ঘোষণা করা হয়৷

No comments:

Post a Comment