খোঁজাখুঁজি

Monday, September 5, 2011

মাসকাবারি বইপত্তর - অগাস্ট

এই কিছু বছর ধরে আমার স্বভাব এমন হয়েছে, একসাথে দুই তিনখানা বই, কখনও বা চার পাঁচখানাও একসাথে শুরু করি, তারপর তারা বিভিন্ন সময়ে পড়া শেষ হয়৷ হঠাত্ই মনে হল প্রতি মাসের শেষে একটা হিসাব রাখলে মন্দ হয় না, কোনগুলো শেষ হল আর কেমন লগল তার৷ নিতান্তই সংক্ষিপ্তাকারে শুরু করি, পরে দেখা যাবেখন৷

এইমাসে শেষ করলাম
১) 'বড়ো বাড়ির ছোটো স্মৃতি' - স্মৃতি মিত্র
২) 'আমার সংসার' - শরত্কুমারী দেব
৩) স্মৃতির সৌরভ' - কল্যাণী সুর
৪) 'আশকথা পাশকথা' - মন্দার মিত্র

কলকাতার যে প্রাচীন পরিবারগুলো খুব বিখ্যাত, তাদেরই একটি পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ পরিবার৷ সেই পরিবারের মেয়ে স্মৃতির বিয়ে হয়েছিল আরেক অতি বিখ্যাত পরিবার, রাজা দিগম্বর মিত্রের বংশধরের সাথে৷ এই দুই পরিবারের সাবেকি জীবনযাত্রার অন্তরঙ্গ বিবরণ 'বড়ো বাড়ির ছোটো স্মৃতি'৷ স্মৃতি মিত্রের কন্যা সীতা ও নাতনি সুকন্যার সৌজন্যে স্মৃতিদেবীর এই ব্যক্তিগত আখ্যানটি প্রকাশ পেয়েছে৷ সঙ্গে আছে কিছু দূর্লভ আলোকচিত্র৷ সেকালের জীবনযাত্রা, একাধিক কন্যা থাকা সত্ত্বেও অপুত্রক হলে দত্তক নেওয়ার প্রথা এবং সেজন্য উদ্ভুত বিচিত্র বৈষয়িক সমস্যা, মামলা মকদ্দমা, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে জাঁকজমক, ঠাটবাট ইত্যাদির জমজমাট বর্ণনা আছে এই বই জুড়ে৷ পড়তে ভালই লাগে৷ আত্মীয়দের মধ্যে মামলা মকদ্দমা বা নিজের দিদিমা, মামাদের লোভ ইত্যাদির মত অপ্রিয় বিষয়গুলি স্মৃতিদেবী এড়িয়ে যান নি৷ এইজন্য বইখানা আমার কাছে আকর্ষণীয় লেগেছে৷

ব্রাহ্মসমাজের নেতা শিবচন্দ্র দেবের পুত্রবধু শরত্কুমারী দেবী৷ শরত্কুমারীর জন্ম হয়েছিল ১৮৬১, মৃত্যু ১৯৪১৷ রবীন্দ্রনাথের সাথে জন্ম ও মৃত্যুর বছর একেবারে মিলে যাওয়াটা বেশ ইন্টারেস্টিং৷ শরত্কুমারীর শ্বশুর শিবচন্দ্র দেব ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু৷ শিবচন্দ্রের পুত্র সত্যপ্রিয় দেবের মৃত্যুর পর শরত্র্কুমারী এই স্মৃতিকথাটি লেখেন৷ নিতান্ত পাতলা ৪৩ পৃষ্ঠার বই৷ বইটা কৌতুহলপ্রদ, কারণ যে পটভূমিতে বইটি লেখা সেটি দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, বিশেষত ব্রাহ্ম আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় যুগ৷ বইটি সেই ইতিহাসের উপরে কিছু আলোকপাত করে৷ বইটির লেখার ধরণ একটু আড়ষ্ট, বিশেষ করে একেবারে পতিদেবের ছায়া হয়ে থাকা শরত্কুমারীর লেখায় একটা একপেশে ব্যপার আছে৷ আবার শরত্কুমারীর পিতা গোঁড়া হিন্দুসমাজের গণ্ডীর বাইরে এসে নিজের বিশ্বাসমত ব্রাহ্ম পদ্ধতিতে কন্যার বিয়ে দিয়ে কি পরিমাণ বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেই বর্ণনা আকর্ষণীয়৷

স্মৃতিকথাগুলির কোন কোনওটাতে শুধু যিনি লিখছেন তাঁর ও তাঁর আত্মীয় পরিজনের কথা থাকে, কোনও কোনওটিতে আবার তাঁর দেখা জীবন ও লোকজনের কথাই বেশী থাকে৷ কল্যাণী সুরের বইটি এই দ্বিতীয় গোত্রের৷ তাঁর শৈশব, কৈশোর কেটেছে গান্ধীবাদি পিতা ও স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষজনের সংস্পর্শে, শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি সাহচর্য্যে, রবীন্দ্রনাথকে দেখার অপার সৌভাগ্যে৷ সেইসময়ের মধুর স্মৃতি তাঁকে ভুলিয়ে রেখেছে বিবাহপরবর্তী তিত্ক অভিজ্ঞতার সময়েও৷ কোনও তিক্ততার কথা তিনি লেখেন নি বইটিতে৷ শুধু শুনিয়ে গেছেন আনন্দের কথাগুলো, আদর্শের কথাগুলো৷ প্রসঙ্গত: একবার এসেছে বিবাহ পরবর্তী জীবনে তাঁর একবার কা`কের মানসিক চিকিত্সালয়ে বাস করার গল্প৷ কিন্তু তার আগে পরে আর কিছুই বলা নেই৷ ফলে একধরণের অতৃপ্তির সৃষ্টি হয়৷ অপ্রিয় বিষয়গুলি এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া বইটি চমত্কার৷ মানবীবিদ্যার পাঠেও এ বইটি উল্লেখযোগ্য লেখিকা ও তাঁর মায়ের কারণে৷

'আশকথা পাশকথা' খানিকটা কলাণী দত্ত'র 'থোড় বড়ি খাড়া' ধরণের বই৷ সেকালের যেসব জিনিষ, আচার আচরণ এখন আর তেমন দেখা যায় না, তাই নিয়ে কলাম গোছের লেখা৷ কিন্তু এই বইটি ভারী সুখপাঠ্য৷ ছোট্ট নোটবইয়ের আকারে, হালকা কমলারঙা কাগজে ছাপা বইটির মুদ্রণসৌকর্য্যও দেখবার মত৷ মন্দার মুখোপাধ্যায়ের লেখার গুণে 'জামাইষষ্ঠী'র মত নিতান্ত জানাশোনা ব্যপারগুলোও পড়তে দিব্বি লাগে৷


তো, এই হল গিয়ে অগাস্টে শেষ করা বইপত্তর৷ শুর করা, কিন্তু শেষ না হওয়া বইয়ের নামগুলো আর লজ্জার মথা খেয়ে দিলাম না এখানে৷

No comments:

Post a Comment